দিল্লি থেকে তারকা এনে হবে না। যেতে হবে একেবারে বুথ স্তর পর্যন্ত। হাওড়ার ফলে কংগ্রেস টের পেয়েছে, একা লড়তে গিয়ে সস্তায় বাজিমাত করতে চাইলে হবে না!
বাইরে থাকা আসা সাংসদ বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দিয়ে রোড শো বা এক-দু’টি সভা করিয়ে দলের ভোট-ব্যাঙ্ক যে তৈরি করা যাবে না, হাওড়ার দলের ফল দেখে প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এখন অনুধাবন করতে শুরু করেছেন। সামনে পঞ্চায়েত, তার পরে লোকসভা ভোট। সেখানে হাওড়ার আর পুনরাবৃত্তি চান না প্রদেশ নেতৃত্ব। হাওড়ার উপনির্বাচনে একক ভাবে লড়াই করে কংগ্রেস তৃতীয় স্থান পেয়েছে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “আমাদের যে জামানত জব্দ হয়নি, সে জন্য হাওড়ার কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানানো উচিত!” ন’বছর আগে শেষ যে বার হাওড়ায় কংগ্রেস একক ভাবে লড়েছিল, সে বার কংগ্রেস প্রার্থী সুলতান সিংহ (অধুনা তৃণমূল বিধায়ক) পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৬২ হাজার ভোট। এ বার উপনির্বাচনে কংগ্রেসের সনাতন মুখোপাধ্যায় পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৭৪৩ ভোট। বিস্মিত প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের কারও কারও মতে, হাওড়ায় দলীয় প্রার্থীর ভোট আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস প্রার্থী অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এক লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন। সেই ভোট কেন এ ভাবে কমে গেল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে দলের অন্দরে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য শুক্রবার দিল্লি থেকে জানান, হাওড়ার প্রার্থী সনাতনবাবু এবং জেলা কংগ্রেস সভাপতি কাজি আব্দুল রেজ্জাকের কাছ থেকে আলাদা ভাবে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। এই ভোটে কংগ্রেসের পাশাপাশি অন্যান্য দলের অবস্থানও বিশ্লেষণ করা হবে বলে প্রদীপবাবু জানিয়েছেন। হাওড়ার ভোট-পরবর্তী কালে কী করণীয়, তা নিয়ে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক ও পশ্চিমবঙ্গে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাকিল আহমেদের সঙ্গেও কথা বলবেন প্রদেশ সভাপতি।
তবে প্রদেশ নেতাদেরই একাংশের অভিমত, দীর্ঘ দিন পরে একা লড়ে যে ভোট পাওয়া গিয়েছে, তা কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের কাছে যথেষ্টই উৎসাহব্যাঞ্জক। কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর মতে, “হাওড়ায় আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছি। এটা ভাল ইঙ্গিত। এ বার দলের সাংগঠনিক শক্তিকে সুসংহত করে কাজে লাগাতে হবে।” অধীর বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে বলছেন, “গত ন’বছর ধরে হাওড়ায় কংগ্রেস তো অনাথ হয়ে পড়েছিল! জেলায় আমাদের সবেধন নীলমনি শ্যামপুরের বিধায়ক অসিত মিত্র। কংগ্রেসের হাত চিহ্নে ভোট দেওয়া তো হাওড়ার মানুষ ভুলে গিয়েছিলেন!” সেই পরিস্থিতি থেকে মুখ রক্ষার মতো ভোট সনাতনবাবু পেয়েছেন বলে মনে করেন অধীর-অজয়বাবুরা।
কংগ্রেসের যে একটা পরম্পরাগত ভোট সর্বত্র আছে, হাওড়ার উপনির্বাচন থেকে তা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে বলে দলের নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার মতে, “মিছিল-মিটিং করে প্রচারে ঢেউ তোলা যায়। কিন্তু ভোট বাক্স ভরাতে বুথ স্তর থেকে সংগঠন তৈরি করাটা জরুরি। পঞ্চায়েত ভোটের আগে আমাদের সেটা করে ফেলতেই হবে।” কেন জরুরি, তা বোঝাতে মানসবাবু বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী করা হয় বুথ স্তর থেকে। ফলে প্রার্থী ও বুথ কমিটির মধ্যে সমন্বয় দরকার। আর পঞ্চায়েতের পরেই লোকসভা ভোট। বুথ কমিটি থেকে একেবারে জেলা স্তর পর্যন্ত কমিটি করে এগোলে আমাদের ফল ভাল হতে বাধ্য।” দলের অনেক নেতার ব্যাখ্যা, হাওড়ায় এ রকম ভাবে কাজ হয়নি। জেলার বিভিন্ন নেতা থেকে শুরু করে নিচু তলায় কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। বহু জায়গায় সময় মতো ভোটার স্লিপও পৌঁছনো যায়নি সমন্বয়ের অভাবেই।
মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, নদিয়া, পুরুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে কংগ্রেসের মজবুত সংগঠন আছে বলে মানসবাবুরা মনে করছেন। কিন্তু যে সমস্ত জেলায় সংগঠন দুর্বল, সেখানে অবিলম্বে নজর না দিলে লোকসভা ভোটে একা লড়তে গিয়ে মাসুল দিতে হতে পারে কংগ্রেসকে। তাই মানসবাবুর প্রস্তাব, “রাহুল গাঁধীর নির্দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে যুব কংগ্রেসে বুথ স্তর থেকে কমিটি হয়েছে। যুব কংগ্রেসের যে পরিকাঠামো ও যোগাযোগ (‘নেটওয়ার্ক’) আছে, তা কংগ্রেসের সংগঠন মজবুত করতে কাজে লাগানো দরকার।” সম্প্রতি প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে কিছু রদবদল করেছে হাইকম্যান্ড। রদবদলের জেরে প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন খালিদ ইবাদুল্লা, শুভঙ্কর সরকার, কনক দেবনাথ প্রমুখ। ইতিমধ্যেই যুব কংগ্রেস সভাপতি সৌমিক হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে বুথ ভিত্তিক কমিটি গঠনের জন্য ইবাদুল্লারা কাজও শুরু করেছেন। |