বাম-ক্ষয়ে রাশ
জোট চাই, বোঝাল গরহাজির বিজেপি
প্রবল চাপের মুখে পরীক্ষায় উতরে গেলেও ভবিষ্যতের ভাবনা থেকেই গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের!
সিপিএমের শ্রীদীপ ভট্টাচার্যকে প্রায় ২৭ হাজার ভোটে হারিয়ে হাওড়া লোকসভা আসন তৃণমূলের দখলে রেখে দিলেন প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। সারদা কাণ্ড থেকে শুরু করে নানা কারণে জেরবার তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে সেটা সুখবর ঠিকই।
তবে বছর ঘুরলেই যে লোকসভা ভোট, তার নিরিখে কিন্তু অস্বস্তিতেই রইলেন তিনি।
পরিস্থিতি যে প্রতিকূল ছিল, ভোটের ফল প্রকাশের পরে সে কথা কবুল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। তাঁর কথায়, “এই ভোটের অঙ্ক অন্য রকম ছিল। অন্য কোনও ভোটের সঙ্গে হাওড়ার উপনির্বাচনকে তুলনা করা যাবে না। এই নির্বাচন অন্য যে কোনও নির্বাচনের চাইতে কঠিন ছিল!”
কিন্তু ভোটের ময়দান থেকে বিজেপি সরে না-দাঁড়ালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই ‘কঠিন লড়াই’য়ে স্বস্তির হাসি মমতা হাসতে পারতেন কি না, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনেও দাঁড়াতে হচ্ছে তৃণমূলকে। দু’বছর আগে ‘পরিবর্তন’-এর ভোটে প্রবল মেরুকরণের সময়েও হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা আসন মিলিয়ে বিজেপি প্রায় ৪৯ হাজার ভোট পেয়েছিল। তৃণমূলের জমানায় সরকার-বিরোধী আন্দোলনের জেরে গত দু’বছরে তাদের প্রাসঙ্গিকতা রাজ্য রাজনীতিতে কিঞ্চিৎ বেড়েছে। তা ছাড়া, গোটা দেশেই এখন ২০১১-র তুলনায় বিজেপি-র পক্ষে হাওয়া তুলনামূলক ভাবে বেশি।
প্রত্যাশা পূরণ। বুধবার মহাকরণে। —নিজস্ব চিত্র
ফলে কংগ্রেস এ দিন তৃণমূলের হাওড়া-জয়কে বিজেপি-র তরফে ‘উপহার’ বলে কটাক্ষ করেছে! প্রায় একই সুর বামেদেরও। অনেকেই বলছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতার গন্ধ পেতে শুরু করেছে বিজেপি। ফলে তারা আরও তরতাজা হয়ে লোকসভা ভাটে নামবে। সে ক্ষেত্রে জোট না-গড়লে মমতার পক্ষে রাজ্যে নিজের দুর্গ ধরে রাখা কঠিন হবে। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কারণে তৃণমূলের পক্ষে বিজেপি-র সঙ্গে যাওয়া কঠিন। এই বাধ্যবাধকতা লোকসভা ভোটের আগে ফের কংগ্রেস-তৃণমূল সমঝোতার পথ খুলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে প্রতিকূলতার মধ্যেও এই জয় মমতার দর কষাকষির জোর যে অনেকটাই বাড়াল তাতে সন্দেহ নেই।
মমতা নিজে অবশ্য এ দিন বলেছেন, “লড়াইটা একার লড়াই ছিল। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-র সঙ্গে লড়াই। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধেও আমরা একা লড়াই করে জিতেছি। একলা চলার বার্তা দিয়েছে এই নির্বাচন।” কিন্তু দলের অভ্যন্তরে তৃণমূল নেতৃত্বও বুঝতে পারছেন, সর্বভারতীয় কোনও দলের জোটসঙ্গী না-হয়ে বেশি দিন নিজেদের শক্তিক্ষয় আটকানো মুশকিল। ভবিষ্যতে জোটের সম্ভাবনা আছে কিনা, এই প্রশ্নে এ দিন কৌশলী জবাব দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, “আমাদের জোটের প্রয়োজন নেই! জোটের প্রয়োজন কংগ্রেসের। জঙ্গিপুরে আমরা প্রার্থী দিলে কংগ্রেস কি জিতত? আমরা কিন্তু একক ভাবে লড়ে সব জায়গাতেই জিতছি।”
জোট না করেও জয় যদি হাওড়া উপনির্বাচন থেকে তৃণমূলের প্রাপ্তি হয়, তা হলে বামেদের প্রাপ্তি গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার ইঙ্গিত। তবে ক্ষত তাদের এখনও রয়েই গিয়েছে। চার বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে হাওড়ায় বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল প্রায় ৪৪%। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে সেই হার আরও কমে হয়েছিল ৩৭%। ২০০৯-এর ক্ষয় মেরামতের অবস্থায় না পৌঁছলেও এ বারের উপনির্বাচনে খানিকটা ঘর গুছিয়ে নিজেদের ভোটের হার ৪১.৭%-এ নিয়ে যেতে পেরেছে সিপিএম।
হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে তো বটেই, গোটা জেলাতেই একটিও বিধানসভা আসন এখন বামেদের দখলে নেই। সেখানে এই উপনির্বাচনে সাঁকরাইল ও দক্ষিণ হাওড়ায় ‘লিড’ পেয়েছেন শ্রীদীপবাবু। বালিতে হার হয়েছে আড়াই হাজারেরও কমে, উত্তর ও মধ্য হাওড়ায় কমে এসেছে ব্যবধান। একে যথেষ্ট ইতিবাচক বলেই মনে করছে আলিমুদ্দিন।
জয়ের ব্যবধান কমে আসাকে অবশ্য বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল শিবির। বিধানসভা ভোটে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি কেন্দ্র মিলিয়ে তৃণমূলের ‘লিড’ ছিল ১ লক্ষ ৮৬ হাজার। (তখন অবশ্য কংগ্রেস তাদের সঙ্গে ছিল) ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও ৩৭ হাজার ভোটে জিতেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ওই দুই নির্বাচনের সঙ্গে এই উপনির্বাচনের কোনও তুলনাই চলে না বলে তৃণমূল শিবিরের দাবি। মমতাও বলেন, “২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে হাওড়ায় ৭৭% ভোট পড়েছিল। এ বারের উপনির্বাচনে ৬৭-৬৮% ভোট পড়েছে। কেউ কেউ বলছে, কারও ভোট বেড়েছে। তৃণমূলের ৩% কমলো, না সিপিএমের ৪% বাড়ল, এটা সেই অঙ্ক নয়!”
অঙ্ক বলছে, তৃণমূল এ বার হাওড়ায় ৪৪.৫% ভোট পেয়েছে। কংগ্রেস এবং তৃণমূলের জোট ২০১১-এ পেয়েছিল ৫৪%-এর কিছু বেশি এবং ২০০৯-এ ৪৮%। জোটের মধ্যে কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট আলাদা করা সম্ভব নয় বলেই এ বার উপনির্বাচনে একক ভাবে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে না কমেছে, তা ধরা মুশকিল। যদিও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের ব্যাখ্যা, কংগ্রেস উপনির্বাচনে ১০% ভোট পেয়েছে আলাদা লড়ে। জোটে থাকাকালীন ২০০৯-এও কংগ্রেসের জন্য ওই ১০%-ই ছেড়ে রাখলে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৮%। সেই নিরিখে বিচার করলে এ বার তৃণমূলের ভোট বেড়েছে প্রায় ৬%।
কিন্তু বিজেপি প্রার্থী দিলে তৃণমূলের ফল কী হত, সেই প্রশ্ন থাকছেই। বিজেপি-যোগেই এ দিন মমতাকে আক্রমণ করেছেন বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের গোপন আঁতাঁত আমরা বারবারই বলছি। পরস্পরের বার্তা বিনিময় হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। হাওড়ায় তৃণমূলের জয়ের পিছনে বিজেপি-র অবদান আছে।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশের মন্তব্য, “হাওড়ার থিম হচ্ছে, সামনে তৃণমূল, পিছে কমল কি ফুল!” একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা শাকিল আহমেদ বলেছেন, “বিজেপি-ই আসনটা তৃণমূলকে উপহার দিল। আমরা গোড়া থেকে যা বলছিলাম, সেটাই স্পষ্ট হয়ে গেল!” একই কথা বলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারাও। মমতা অবশ্য বলেছেন, “চাই না বিজেপি-র ভোট! একক ভাবে লড়েই আমরা জিতেছি। এই জয় আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াল।” বিজেপি-সমর্থিত দুই নির্দল প্রার্থীর প্রসঙ্গও তুলেছেন তিনি। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-র ভোটে হাওড়ার ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রেই বিজেপি-র প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নির্দলেরা যত ভোট পেয়েছিলেন, এ বারও তা-ই পেয়েছেন। ফলে কংগ্রেস-সিপিএমের দাবি, বিজেপি-র ভোট নির্দলদের বাক্সে যায়নি। আর বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “এটা ঠিক যে, আমাদের প্রার্থী থাকলে তৃণমূলের জয় কঠিন হতো। কিন্তু কংগ্রেস, সিপিএমকে সুবিধা করে দেওয়াও আমাদের কাজ নয়। তৃণমূলের সুবিধা করে দিতেও আমরা লড়াই থেকে সরিনি। যা করেছি, নিজেদের সুবিধার্থে করেছি।” রাহুলবাবুর দাবি, হাওড়ায় বিজেপি সমর্থকদের বড় অংশই ভোটদানে বিরত ছিলেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.