|
|
|
|
সংসদে ফুটবলের খাতা খুললেন প্রসূনই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মাঠের খেলা ছেড়েছেন তিন দশক আগে। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁ পায়ের জাদুর কথা এখনও মুখে মুখে ফেরে। এ বার রাজনীতির ময়দানে খেলতে নেমেও প্রথম ম্যাচেই গোল। হাওড়া লোকসভা উপনির্বাচনে বামপন্থীদের ছিটকে দিয়ে প্রসূন দেখালেন, আজও তিনি ম্যাচ উইনার।
তবে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় স্রেফ মমতার হয়ে সিপিএম-কংগ্রেসকে গোল দিয়েছেন বলাটা ভুল হবে। এ দেশের গোটা ফুটবল-সমাজের হয়েই এ এক দুর্দান্ত গোল বলে মনে করছেন ক্রীড়ামোদীরা। কারণ ক্রীড়াবিদের সংসদে যাওয়ার নজির বেশ কয়েকটি মিলবে। ক্রিকেটের আজহার-সচিন, হকির দিলীপ তিরকে-রা তো সংসদে রয়েইছেন। এশিয়াডের ‘সোনার মেয়ে’ অ্যাথলিট জ্যোতির্ময়ী শিকদারও সিপিএমের হয়ে ভোটে জিতে লোকসভায় গিয়েছিলেন। ছিলেন না শুধু কোনও ফুটবলার। বাংলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ফাঁকটুকু এ বার ভরাট করলেন। |
|
প্রাক্তন ফুটবল তারকাকে স্বাগত রাজনীতিতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার |
মহম্মদ আজহারউদ্দিন, সচিন তেণ্ডুলকর বা দিলীপ তিরকের মতো প্রসূনও টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু সচিন বা পেনাল্টি-কর্নার বিশারদ দিলীপের তুলনায় প্রসূনের সংসদ-যাত্রার পথটা অন্য রকম। এক বছর আগে দেশের রাষ্ট্রপতি সচিনকে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত করেন। ওই সময়েই ওড়িশার বিজু জনতা দলের তরফে সুন্দরগড়ের যুবক দিলীপকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রসূনকে উপনির্বাচনে কঠিন যুদ্ধে জিতে লোকসভায় ঢুকতে হয়েছে। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে আজহারও উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ কেন্দ্রে জিতেই এসেছিলেন।
রাজনীতির মাঠে গোল করা যে একটা আলাদা ব্যাপার সেটা প্রসূন বিলক্ষণ বোঝেন। জয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় মহাকরণে গিয়ে নিজে বলেওছেন সে-কথা। আর ফুটবলটাকে এমন উচ্চতর মার্গে
নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ক্যাপ্টেন’ মমতাকেই ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি। কালীঘাটে মমতার বাড়ি গিয়ে দেখাও করে এসেছেন। |
|
১৯৭৭। ইডেন গার্ডেন্সে পেলে বনাম প্রসূন।—ফাইল চিত্র |
উত্তেজনায় ফুটছেন প্রসূনের ১৮ বছরের বড় দাদা, পিতৃপ্রতিম প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পিকে-র দাবি, রাজনীতির এই লড়াইয়ে তাঁর ফুটবলার ভাইয়ের ভাবমূতির্র্ মমতাকে বাড়তি অ্যাডভান্টেজ দিয়েছে। “আমার গোপালের (প্রসূনের ডাকনাম) বিরুদ্ধে বলার মতো কারও একটা কথাও ছিল না। ও তো আর রাজনীতির ছেলে নয়। এই ম্যাচে ওকে রুখতে কোনও স্ট্র্যাটেজিই কাজে এল না!” এমন সুখের দিনে দাদার মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলার কথা। “তখন বাঘা সোমের কাছে প্র্যাকটিস সেরে আমি নিজের বরাদ্দ ডিম-রুটি-কলা ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসতাম। কলের জল খেয়ে
পেট ভরিয়ে নিতাম। সেই ছোট ভাই একদিন ফুটবলার হল। তার পরে ভোটে জিতে এমপি!”
ভোটযুদ্ধে লড়তে নেমে প্রসূন নিজেও বারবার তাঁর ফুটবলার-সত্তাকেই মেলে ধরছেন। মোহনবাগান বা জাতীয় দলে সতীর্থ, প্রসূনের প্রিয় ‘জেঠু’ অর্থাৎ গৌতম সরকারও উচ্ছ্বসিত। “আমি বলেছিলাম, গোপাল তুই কিছুতেই হারবি না!” |
হাওড়া সদর কেন্দ্রের বিধানসভা ভিত্তিক ফল |
|
বালি |
পাঁচলা |
তৃণমূল ৪১,৯৬৩টি ভোট |
তৃণমূল ৬৯,৬১২টি ভোট
|
সিপিএম ৩৯,১৪৫টি ভোট |
সিপিএম ৫৯,৬৫২টি ভোট
|
কংগ্রেস ৬,৮৬৪টি ভোট |
কংগ্রেস ১৭,৬৫৭টি ভোট |
|
উত্তর হাওড়া |
মধ্য হাওড়া |
শিবপুর |
তৃণমূল ৫০,৮২৮টি ভোট
|
তৃণমূল ৬২,৭৫৮টি ভোট
|
তৃণমূল ৬৯,৩২৭টি ভোট
|
সিপিএম ৪৩,৮৭৫টি ভোট
|
সিপিএম ৫৩,৩৯৯টি ভোট
|
সিপিএম ৬২,২৮০টি ভোট
|
কংগ্রেস ৯,৬৩০টি ভোট |
কংগ্রেস ১৯,২৭৬টি ভোট |
কংগ্রেস ১১,৬৭৯টি ভোট |
|
পাগলপারা। হাওড়ায় তৃণমূল সমর্থকদের ছবিটি তুলেছেন সুব্রত জানা। |
দক্ষিণ হাওড়া |
সাঁকরাইল |
তৃণমূল ৭০,০৪৯টি ভোট
|
তৃণমূল ৬১,৭৩৭টি ভোট
|
সিপিএম ৭২,৫৬৮টি ভোট
|
সিপিএম ৬৮,৩৩৯টি ভোট
|
কংগ্রেস ১১,০১৩টি ভোট |
কংগ্রেস ২০,৬০৮টি ভোট |
|
|
আর এক প্রাক্তন ফুটবলার চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ’৯৬ সালে কংগ্রেসের টিকিটে বিধানসভা ভোটে লড়ে অসীম দাশগুপ্তের কাছে হেরেছিলেন। মমতা তখন যুব কংগ্রেস নেত্রী হয়ে তাঁর প্রচারে গিয়েছিলেন। “আমি আর প্রসূনদা তখন থেকেই দিদির ভক্ত। প্রসূনদা জেতায় যেন নিজের সেই হারের ঝাল মিটল!” বলছেন চিন্ময়।
দাদা পিকে থেকে শুরু করে মাঠের সহযোদ্ধা-বন্ধু গৌতম, শ্যাম থাপা, মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসু, সমরেশ চৌধুরী, কম্পটন দত্ত, নিমাই গোস্বামী, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়দেরও প্রসূন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন জনসভা বা পদযাত্রায়। সিডনিতে মেয়ের কাছে বেড়াতে গিয়েও শ্যাম এ দিন বন্ধুদের কাছে ‘গোপালে’র যুদ্ধজয়ের খবর নিয়েছেন। মোহনবাগানের শক্ত ঘাঁটি হাওড়ায় সবুজ-মেরুনের ‘ঘরের ছেলে’ ইমেজকে কাজে লাগাতেও কসুর করেননি প্রসূন। ম্যাচে জেতার পরে সবুজ আবিরের সঙ্গেই তাঁর গালে লালচে আবিরের ছোপ।
অনেকটা সবুজ-মেরুন নকশার মতোই লাগছে।
কিন্তু জিতলেও ফুটবলের হাল ফেরাতে একা প্রসূন কত দূর এগোতে পারবেন! প্রসূনকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েও প্রশ্নটা ছুড়ে দিচ্ছেন অমল দত্ত। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে, নিজের ভোটে লড়ার স্মৃতি। বড়বাজারে বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়ে একদা সংসদে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন অমল। “মনে হয়েছিল, সংসদে গেলে হয়তো ফুটবলের জন্য কিছু করতে পারব। কিন্তু প্রচারের অত খরচ জোগাড় করতে পারিনি! অন্য ফুটবলারদেরও আমার প্রচারে ডাকা হয়নি।” দাদা পিকে কিন্তু ভাই-তথা-ছাত্র প্রসূনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী, “ওর রোগা চেহারাটা দেখে বোঝা যেত না, গোপাল কতটা লড়াকু! আমি বলছি, রাজনীতিতেও ও লম্বা রেসের ঘোড়া হতেই পারে!”
রাজনীতির মতাদর্শে যাঁরা প্রসূনের সঙ্গে একমত নন, ক্রীড়াজগতের সেই তারকারাও এই জয়ের আনন্দে গা সেঁকে নিচ্ছেন। জাতীয় দলে প্রসূনের সঙ্গে দীর্ঘদিন খেলেছেন, আর এক প্রাক্তন ভারত-অধিনায়ক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলছেন, “আমি বাম সমর্থক হলেও প্রসূনের সঙ্গে সম্পর্কটা এখনও আগের মতোই। হকির আসলাম শের খান, ক্রিকেটের কীর্তি আজাদ, নভজ্যোত সিংহ সিধুরা আগে ভোটে জিতেছেন। ফুটবলার প্রসূনের জন্য গর্ব হচ্ছে।” প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সাঁতারু বুলা চৌধুরীও ‘প্রসূনদা’কে তাঁর ‘তৃণমূলত্ব’ দিয়ে বিচার করতে চান না। বুলা বলছিলেন, “প্রসূনদার সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক। উনি কোন দল, তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না! এক জন খেলোয়াড় সাংসদ বা বিধায়ক হলে সবসময়ই খেলাধুলোর উন্নতির জন্য একটা বাড়তি তাগিদ থাকে।”
মহাকরণে দাঁড়িয়ে ফুটবলের ‘অর্জুন’ প্রসূনও বলছেন, সংসদে গিয়ে দেশের ক্রীড়ানীতি নিয়ে মুখ খোলার কথা! “ভাবতে পারেন, আমাদের কোনও স্পোর্টস বাজেট নেই। অটলবিহারী বাজপেয়ী একবার চেষ্টা করেছিলেন। তার আগে ’৯২ সাল নাগাদ মমতাও কিছু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাহায্য পাননি! আমি লড়ব।” প্রসূনের কথায়, “আমার সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন মমতার টিমে প্রাণপণে খেলব। এমন ক্যাপ্টেন থাকলে ভাঙা হাঁটুতেও মাত করা যায়!”
রাজনীতিবিদ ‘গোপাল’-এর এই চেহারা উপভোগ করছেন পিকে। মিষ্টিমুখের ফাঁকে মৃদু হাসছেন। “আমার কাছে গোপাল কিন্তু বরাবর সেই আদরের ছোট ভাই হয়েই থাকবে।” |
|
|
|
|
|