কার্ডিফে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের বৃহস্পতিবার যতটা পরাক্রমী দেখাল, দেশে ঠিক ততটাই যেন নড়বড়ে হয়ে পড়লেন জাতীয় ক্রিকেট-প্রশাসকরা।
গুরুনাথ মইয়াপ্পনের পর এ দিন বেটিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেন রাজস্থান রয়্যালস মালিক রাজ কুন্দ্রাও। কিন্তু তা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করতে এসে কোথাও যেন নড়বড়ে দেখাল বোর্ডের অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়াকে।
প্রথমত, রাজস্থান নিয়ে বোর্ড ঠিক কতটা কড়া পদক্ষেপ করবে, তার কোনও ইঙ্গিত মিলল না।
দ্বিতীয়ত, এ দিনই সদ্য-পদত্যাগী বোর্ড সচিব সঞ্জয় জাগদালের স্থলাভিষিক্ত হলেন বডোদরার সঞ্জয় পটেল। সেই নির্বাচনে খুঁজে পাওয়া গেল এন শ্রীনিবাসনের পরোক্ষ প্রভাব!
তৃতীয়ত, ডালমিয়া ক্ষমতায় আসার পর ক্রিকেটমহল ধরে নিয়েছিল, গুরুনাথ কাণ্ডের তদন্ত কমিশনে কিছু বদল হবে, কারণ দু’জন বিচারপতিই তামিলনাড়ুর হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা মার খাচ্ছে। কিন্তু ডালমিয়া জানালেন, কমিশনে নতুন কোনও তৃতীয় সদস্য ঢুকছেন না (আগে জাগদালে ছিলেন)। ওই দুই বিচারপতিই থাকছেন। যাঁদের উপর তাঁর সম্পূর্ণ আস্থা আছে।
বৃহস্পতিবার রাতে তাই জল্পনা শাসনের আসল রিমোট কন্ট্রোলটা তা হলে কার হাতে? ডালমিয়াই কি সর্বশক্তিমান? নাকি নেপথ্যে অদৃশ্য হয়ে থেকে যাচ্ছেন শ্রীনি-ই?
অনেকে অবশ্য বলছেন, এ বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। নতুন বেটিং কেলেঙ্কারি নিয়ে সোমবার ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ডালমিয়া। তিনি যে সেই দাপুটে ক্রিকেট প্রশাসকই আছেন, সে দিনই তা প্রমাণের সুযোগ তাঁর।
শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। নতুন বেটিং কেলেঙ্কারি নিয়ে আগামী সোমবার ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ডালমিয়া। তিনি যে আগের সেই দাপুটে ক্রিকেট প্রশাসকই আছেন, সে দিনই তা প্রমাণের সুযোগ তাঁর সামনে। |
এ দিন রাজ কুন্দ্রার বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি নিয়ে পুলিশের দাবির পরপরই দেশ জুড়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ললিত মোদী থেকে শুরু করে সঞ্জয় জাগদালে কেউ বাদ যাননি। মোদী টুইট করেন, ‘টিমের মালিক ও তার টিমকে এখনই বহিষ্কার করো। এ নিয়ে দু’বার ভাবার কোনও জায়গা নেই। আইনে কোথাও কোনও অস্পষ্টতা নেই এটা নিয়ে।’ আইপিএল-সেভেন এবং চলতি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বন্ধ রাখার দাবিও তোলেন মোদী। আর সঞ্জয় জাগদালে স্তম্ভিত। তাঁর মতে, কুন্দ্রা টিম মালিক হয়ে যা করেছেন, চরম অন্যায়। আইপিএলের নিত্যনতুন কেলেঙ্কারির সমাধান পাওয়া নিয়েও সন্দিহান কোনও কোনও প্রাক্তন ক্রিকেটার। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক বিষেণ সিংহ বেদী যেমন একটি চ্যানেলে বলে দিলেন, “সব প্লেয়ার ফিক্সার নয়। কিন্তু সব ফিক্সারই এক এক জন প্লেয়ার। তাই কাজটা কঠিন।” আপাত-সমাধান হিসেবে ক্রিকেটমহল তুলে আনছে বোর্ড-আইপিএলের সংবিধানের একটি ধারাকে। ১১.৩। যেখানে যেখানে বলা আছে, যদি কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক এমন কোনও কাজ করে বসেন যা অনৈতিক এবং যাতে বোর্ডের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, তা হলে তখুনি সেই ফ্র্যাঞ্চাইজিকে বহিষ্কার করা হবে টুর্নামেন্ট থেকে। যা রাজস্থান মালিক করে বসেছেন বলে অনেকের দাবি। অতএব, বহিষ্কারের আইন প্রযোজ্য রাজস্থানের ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বোর্ড চরম সিদ্ধান্তটা নিতে পারবে কি না?
সাংবাদিক সম্মেলনে ডালমিয়া জানালেন, কঠিন শাস্তির প্রয়োজন হলে বোর্ড সেটা নিয়ে ভাববে। কিন্তু বহিষ্কার করা নিয়ে ভেবে দেখবেন কি? এ বার তাঁর জবাব, “কঠিন শাস্তির মানেটা আপেক্ষিক ব্যাপার। রাজস্থান রয়্যালস নিয়ে আমরা জরুরি বৈঠক ডেকেছি। আমি এটা নিয়ে মন্তব্য করতে পারি না। গর্ভনিং কাউন্সিল আর এগ্জিকিউটিভ কমিটি ঠিক করবে।” যে কথা শুনে জাতীয় মিডিয়ার খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে অতীতের দুঁদে বোর্ড মহাকর্তাকে।
দুপুর থেকে এক প্রস্ত নাটক আবার ঘটে রইল সচিব নির্বাচন নিয়েও। এ দিন ডালমিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে শহরে আসেন বোর্ড সিএও রত্নাকর শেট্টি এবং তামিলনাড়ু ক্রিকেট সংস্থার কর্তা কাশী বিশ্বনাথন। এবং সন্ধেয় ডালমিয়া জানিয়ে দেন, নতুন বোর্ড সচিব বডোদরার সঞ্জয় পটেল। কোষাধ্যক্ষ এখনও ঠিক হয়নি। যার পরপরই কেউ কেউ বলতে থাকেন, পটেলের অভিজ্ঞতা বলতে বছরখানেক আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের ম্যানেজার হয়ে যাওয়া। আর বডোদরা ক্রিকেট সংস্থার সচিব পদে বছর দু’য়েক কাটানো। তিনি কী করে বোর্ড সচিব হয়ে গেলেন?
কারও কারও মনে হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণই শ্রীনিবাসনের চাল, আসন্ন সেপ্টেম্বরে বোর্ড নির্বাচনকে সামনে রেখে। বলা হচ্ছে, বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৌরাষ্ট্রের নিরঞ্জন শাহ-কে আসলে এটা পাল্টা শ্রীনি-র। নিরঞ্জন হালফিলে পওয়ার-গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। চেন্নাইয়ে শেষ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ অজয় শিরকের সঙ্গে বেশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করতেও দেখা গিয়েছে। শ্রীনি এ বার তাই পাল্টা ঘুঁটিটা সাজিয়ে রাখলেন নিরঞ্জনেরই পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে পটেলকে বেছে। যাতে নাকি অরুণ জেটলিরও সমর্থন ছিল। এবং এই বোর্ড সচিব নির্বাচনে ডালমিয়ার কোনও ভূমিকাই ছিল না। বলা হচ্ছে, কোষাধ্যক্ষও বাছা হবে সেপ্টেম্বরের নির্বাচনকে মাথায় রেখেই। দক্ষিণাঞ্চল বা পূর্বাঞ্চল থেকে কেউ আসবেন ওই পদে।
আরও আছে। তদন্ত কমিশন অপরিবর্তিত রেখে দেওয়া নিয়ে বলাবলি হচ্ছে বোর্ডের কোনও কর্তা বা প্রাক্তন কোনও ক্রিকেটারে যে হেতু ভরসা পাননি শ্রীনি, তাই কমিশন অপরিবর্তিত। ডালমিয়া-গোষ্ঠী থেকেই কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, সচিব নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে। বলা হচ্ছে, ওয়ার্কিং কমিটি সামনে আছে জেনেও কী করে আগেভাগে সাংবাদিক সম্মেলনে সচিবের নাম ঘোষণা করে দেওয়া হল? সংবিধানে নাকি এমন নেই। বোর্ডমহলের কেউ কেউ আবার সন্দিহান, সোমবারের বৈঠকে রাজস্থান কতটা কড়া শাস্তি পাবে তা নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ যখন কুন্দ্রাকে গ্রেফতার করেনি তখন বোর্ড কতটা চরমপন্থী হবে?
আগামী, ১০ জুন, সোমবার দিল্লিতে ‘শাসনের রিমোট কার হাতে’ মার্কা জল্পনাকে যমুনা-গর্ভে ছুড়ে ফেলার সুযোগ পাচ্ছেন ডালমিয়া। রাজস্থান রয়্যালস নিয়ে কোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারলে, প্রমাণ হয়ে যাবে ডালমিয়া অতীতের ডালমিয়াই আছেন। নইলে? বৃহস্পতিবারের জল্পনাটাই বোধহয় সত্যি মনে হবে।
|