|
|
|
|
তিন দশকের তফাতে হারিয়ে গিয়েছে কয়া
বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য • জলপাইগুড়ি |
কে বলবে এক সময় নৌকা চলত? বছর ভর গভীর জলে মাছ ধরত জেলেরা। বলে না কেউ। জানেও না কেউ। ধান খেতে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করলেন দীনেশ রায়। বয়স সত্তর ছুঁয়েছে। ময়নাগুড়ির জোড়পাকড়ি গ্রামে জন্ম। বললেন, “কত মাছ ধরেছি কয়া নদীতে। বছর ভর জল থাকত। নৌকায় পারাপার করতাম। সবই শেষ হয়ে গেল চোখের সামনে।”
দীনেশবাবু যে কয়া নদীতে মাছ ধরেছেন। এখন সেখানে চাষের মাঠ। নৌকায় বদলে ট্রাক্টর চলছে। এ ভাবে একটি আস্ত নদী জোড়পাকড়ি গ্রামের মানচিত্র থেকে উধাও হতে দেখার আক্ষেপ শুধু ওই প্রবীণ চাষির নয়। এলাকার প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য মন্টু মিশ্র বলেন, “তিন দশক আগেও কয়া নদীকে বইতে দেখেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করবে না।”
কেমন করে উধাও হল কয়া? পেশায় আইনজীবী স্থানীয় বাসিন্দা শিবশঙ্কর দত্ত বলেন, “তিস্তার বালি ও পলি জমে কয়ার গভীরতা ক্রমশ কমেছে। এক সময় জল প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর পরেই শুরু হয় দখল। গত ২৫ বছরের মধ্যে গোটা নদী উধাও হয়ে যায়।” একই অভিজ্ঞতা কৃষক সভার নেতা নির্মল চৌধুরীর। রাখাল সরকার নামে এক চাষি এখন নদী এলাকায় পাঁচ বিঘে জমিতে ধান চাষ করছেন। তিনি বলেন, “এখানেই নদী ছিল। তাই মাটি এত উর্বর।”
একই ভাবে খুট্টিমারি নদী উধাও হয়েছে ময়নাগুড়ির পদমতি-১ এবং পদমতি-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে। নদীর গতিপথে সিপাইপাড়া নাইয়ারবাড়ি নামে বিভিন্ন বসতি এলাকা গড়ে উঠেছে। চলছে চাষ আবাদের কাজ। স্থানীয় বাসিন্দা ধীরেন রায় বলেন, “এক সময় এখানে যে নদী ছিল সেটা বালি দেখে বোঝা যায়। সামান্য মাটি তুললে বালি বার হয়।”
ডাউকিমারিতে হরিয়েছে কাটামারি নদী এবং বারোঘরিয়ার টুকরাই নদী। ৮ বছর আগেও টুকরাই নদীকে নলবাড়ি গ্রামে উৎপন্ন হয়ে জলঢাকা নদীতে মিলে যেতে দেখেছেন বাসিন্দারা। কয়া নদী জোরপাকড়ি গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে তিস্তা থেকে উৎপন্ন হয়ে দশ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে এগিয়ে মেখলিগঞ্জের কাছে তিস্তায় মিলিত হত। খুট্টিমারি জরদা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে মেখলিগঞ্জের কাছে তিস্তায় পড়ত। সেটাও তিন দশক আগে।
গবেষকরা জানান, এ ভাবে ছোট নদী হারানোর সমস্যা উত্তরবঙ্গ জুড়েই। তবে উত্তরবঙ্গে ছোট নদী সংখ্যায় কত ছিল। এখন কটা টিকে আছে তা স্পষ্ট করে কেউ জানাতে পারেননি। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “সে ভাবে তো সমীক্ষার কাজ হয়নি। তবে অসংখ্য নদী বিলুপ্ত হয়েছে। আমাদের সমাজ জীবনে তার প্রভাবও পড়ছে।”
কেন নদী হারাল? গবেষকদের মতে, অববাহিকায় বৃক্ষচ্ছেদন, বেড়ে চলা ভূমিক্ষয় এবং বসতির সম্প্রসারণ। কল্যাণবাবু বলেন, “পাহাড় থেকে নদী নেমে আসার পরে অনেক শাখানদীর সৃষ্টি করে। বালি পাথর জমে বক্ষ উঁচু হলে প্রধান নদী গতিপথ পাল্টে নেয়। তখন শাখা নদী শুকিয়ে যায়। ওই কারণেও অনেক নদী হারিয়েছে।”
জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় দূষণের জন্য নদী হারাতে বসেছে। যেমন, জলপাইগুড়ির কয়া, ধরলা, কুমলাই, কোচবিহারের আমতলি, বানিয়াদহ, উত্তর দিনাজপুরের ভাতা, বেহুলা, কাঞ্চনের মতো কিছু নদী বুজে যেতে বসেছে। তিরতির করে বয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে জরদা, ঘোলানি, কুলকুলি, চেকো, বালা, আংরা ভাসা, ডুডুয়া, রেতি, সাহু, তালমা, পাঙ্গা, রুকরুকা, যমুনা, মালদহের বেহুলা, টাঙ্গন, উত্তর দিনাজপুরের সুই, কুলিক, নাগরের মতো কিছু নদী।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান সুবীরবাবু বলেন, “ছোট ছোট নদীগুলি ভূগর্ভস্থ জলের ভান্ডারকে ঠিক রাখে। এ ছাড়াও জনপদের নিকাশি কাজে বড় ভূমিকা পালন করে। নদী হারিয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন উত্তরবঙ্গে জলস্তর দ্রুত নামছে। অন্যদিকে তেমন বেড়েছে বন্যার আশঙ্কা। সামান্য বৃষ্টির জন্য জনপদগুলি ভাসতে শুরু করেছে। আবহাওয়ায় পরিবর্তন এসেছে। সেচের জলের সমস্যা প্রকট হচ্ছে।”
গত তিন দশক থেকে উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছোট নদী দখল করে বসতি গড়ে তোলার ঝোঁক বেড়েছে বলে মনে করছেন গবেষকদের একাংশ। ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান মধুসূদন কর্মকার বলেন, “এ ছাড়াও ওই সময়ে গঞ্জগুলি অপরিকল্পিতভাবে কলেবরে পাল্টে শহরের রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনের জঞ্জাল কোথায় ফেলা হবে তার কোনও ব্যবস্থা ওই জনপদগুলিতে নেই। সেখানে নদী ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত হয়ে মজে যেতে বসেছে। দ্রুত নদীগুলি সংরক্ষণ ও সংস্কারের ব্যবস্থা করা জরুরি।” |
|
|
|
|
|