গোটা লন্ডন শহরের বাসিন্দাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ভার তিন দশক ধরে যাঁর কাঁধে, তাঁর কাঁধদুটি পাতলা, কোমরটি সরু, আর সটান পা দু’টি হাই-হিল জুতোয় চটপটে। হঠাত্ মনে হয়, সদ্য কলেজ-পেরোন তরুণী বুঝি। যে বিশাল ও জটিল ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের খরচে গোটা দেশের মানুষের চিকিত্সা হয়, তার অনেকটা ভার বয়েছেন এই তন্বী, তা বিশ্বাসই হতে চায় না। কেবল মুখের দিকে নজর করলে বোঝা যায়, ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস যতবার ঢেলে সাজা হয়েছে, ততবার এক একটি রেখা বুঝি আঁকা হয়েছে ওই মুখে। নয় বারের বার বিরক্ত হয়ে ৫৬ বছর বয়সে ইস্তফা দিয়েছেন ‘ডেম’ রুথ কারনেল। এখন নানা দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে পরামর্শ দেন। ‘সবার জন্য চিকিত্সা’ নিয়ে বলতে এসেছিলেন কলকাতায়।
সবার জন্য ভাল চিকিত্সা কি সম্ভব? সরকারি পয়সায়? হোটেলের লবিতে বসে চিনি-ছাড়া কফিতে চুমুক দিয়ে রুথ বললেন, “বেজায় বড়লোক ছাড়া ব্রিটেনে সকলেই কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাতেই চিকিত্সা করায়। আমার পরিবারকে উচ্চবিত্ত বলতে পারেন। আমাদেরও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা নেই, এনএইচএস ভরসা।” একটু থেমে বললেন, “আসলে চিকিত্সায় কতটা উপকার হবে, সেটা ধনী কি গরিব, তার উপর অতটা নির্ভর করে না। করে হাসপাতাল কেমন, তার উপর। ধরুন কারও স্ট্রোক হল। যেখানে স্ট্রোকের স্পেশালাইজড কেয়ার রয়েছে, সেখানে গেলে তার দ্রুত, যথাযথ চিকিত্সা হবে। পাড়ার ছোট হাসপাতালে তা সম্ভব নয়।”
মনে হয়, এ আর কে না জানে। কিন্তু এই কথাটাকেই স্বাস্থ্যনীতির মূল কথা করতে ঢের লড়াই করতে হয়েছে রুথকে। লড়াই রাজনীতির নেতাদের সঙ্গে, ডাক্তারদের সঙ্গে, আমজনতার সঙ্গেও। “সবাই চান, বাড়ির কাছের হাসপাতালে সব চিকিত্সা যেন পাওয়া যায়। আসলে তার মানে দাঁড়ায়, সেরা চিকিত্সা না পাওয়া।” স্ট্রোকের চিকিত্সারই উদাহরণ দিলেন রুথ। পাড়ার হাসপাতালগুলোতে স্ট্রোক চিকিত্সার বিশেষ ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে লন্ডনের লোকে বিরক্ত। তাঁদের বোঝানো যাচ্ছে না, স্ট্রোকের চিকিত্সা কেন্দ্রিকরণ করলে ফল হয় অনেক ভাল।
কেমন সেই ব্যবস্থা? শহরের আটটি হাসপাতালে ‘হাইপার অ্যাকিউট স্ট্রোক ইউনিট’ তৈরি করে, ৯৯৯ ডায়াল করলেই সেখানে রোগী নিয়ে যাওয়ার নিয়ম তৈরি করেছেন রুথ। যেতে লাগে বড় জোর ৪০ মিনিট। তিন দিন পর স্থানীয় হাসপাতালে ফিরিয়ে দেওয়া হয় রোগীকে। “এই ব্যবস্থায় স্ট্রোকে মৃত্যুহার কমেছে ২৫ শতাংশ, টাকাও বেঁচেছে। ব্রিটেনের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় লন্ডনে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড কম খরচ হয়।”
শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার কথা। হাসপাতালে প্রসব বাড়ছে অথচ মায়ের মৃত্যু কমছে না কেন, প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, “তাকিয়ে দেখুন কলকাতা থেকে বারাসত যাওয়ার রাস্তাটার দিকে। প্রতি দু-আড়াই কিলোমিটার অন্তর একটা হাসপাতাল, প্রতিটিতে দু’-তিনজন গাইনোকলজিস্ট, এক-দু’জন অ্যানেস্থেটিস্ট। জেনারাল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার না থাকায় এই ডাক্তারদের সব রকম রোগী দেখতে হয়। ফলে কোনও হাসপাতালেই ২৪ ঘন্টা সিজারিয়ান হয় না।” এলাকার কোনও একটি হাসপাতালে যথেষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাখা হলে কলকাতায় রেফার করার হাঙ্গামা, বিলম্বের জন্য মৃত্যু এড়ানো যেত না কি?
সে প্রশ্নটা তোলাই হয় না, কারণ প্রতিটি সাংসদ, বিধায়ক, পুরপিতা তাঁর নিজের এলাকার হাসপাতালে ‘সিজার’ চালু করবেনই করবেন। ওদের আছে, আমাদের নেই কেন, এই হল যুক্তি। স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করার দিনে বিধানসভায় সেই একই দৃশ্য দেখা যায়। কেন মহকুমা হাসপাতালে এমআরআই হবে না, কেন কার্ডিয়াক সার্জারি হবে না স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, তাই নিয়ে শোরগোল চলে। সব হাসপাতালে সব পরিষেবা চালু করা সম্ভব কি না, করা উচিত কি না, তা নিয়ে চিন্তা করে কে?
গণস্বাস্থ্যের নীতিতে জনমতকে কতটা পাত্তা দেওয়া উচিত, তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরাও। অভিজিত্ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন, নানা দেশে গরিব মানুষ সাধ্যাতিরিক্ত খরচে চিকিত্সা করান, কিন্তু টিকাকরণ, পরিশোধিত জল খাওয়া কিংবা মশারি টাঙানোর জন্য সামান্য খরচ করেন না। রোগ প্রতিরোধের বরাদ্দ কাজে না লাগিয়ে জনমত যদি ক্রমাগত আরও সস্তায় আরও ভাল চিকিত্সা চায়, সেই দাবিকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া চলে? জিষ্ণু দাশ দেখিয়েছেন, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তারের চিকিত্সার মান হাতুড়েদের চিকিত্সার চাইতে উঁচু দরের নয়। আরও, আরও বেশি পাশ-করা ডাক্তারকে গ্রামে পাঠালে গণস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এই কথা মানলে কেবল অপচয় বাড়বে, অসুখ কমবে না।
এ কথাগুলো নেতারাও বোঝেন, বললেন রুথ। “আমার সবচেয়ে বিরক্ত লাগে যখন নেতাদের দেখি একান্তে বলছেন, ‘আমার পরিবারের জন্য এমন চিকিত্সাই চাই, কিন্তু বাইরে তো আর বলতে পারি না।’ কেন পারেন না? কী করলে কম খরচে বেশি রোগী নিরাময় হ’ন, সে বিষয়ে হাতে-কলমে যা জানা গিয়েছে তা সবাইকে বোঝানোর কাজটা তো নেতাদেরই।” আরও অনেক বড় হাসপাতাল তৈরি করার চাইতে ৯৯৯ ডায়াল করে যে পরিষেবা পাওয়া যায় তাকে উন্নত করলে, ছোট হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সি বিভাগকে উন্নত করলে উপকার হবে অনেক বেশি, তা কে বোঝাবে ব্রিটেনের আম-ভোটারকে?
কে-ই বা বোঝাবে বাংলার নাগরিককে? কল্পচক্ষে দেখার চেষ্টা করুন, বিধানসভায় নেতারা তর্ক করছেন, কী করে নবজাতকের মৃত্যু কমানো যায়। মহকুমা কি ব্লক স্তরে নবজাতক ইউনিট তৈরি করে তার যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্স জোগান দেওয়ার জন্য বিপুল খরচ (গত এপ্রিল মাসে সরকার ১৬১ জন শিশুবিশেষজ্ঞ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কেবল সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটগুলোর জন্য) করাই কি উচিত? নাকি নিচুতলার স্বাস্থ্য কর্মীদের দিয়ে মায়ের অপুষ্টি কমালে শিশুমৃত্যু দ্রুত কমত? না, বহু চিন্তা করেও ২৯৫টা মুখের মধ্যে থেকে একটা মুখ ভাবা গেল না যিনি বলবেন, আমার এলাকার হাসপাতালে এসএনসিউ খোলার দরকার নেই, ভাল হাসপাতালে পৌঁছনোর রাস্তা আরও ভাল করুন।
নেতারা সব দেশেই সমান। “টপ-ডাউন প্ল্যানিং হঠিয়ে রোগীকে বেশি ‘চয়েস’ দেওয়া, চিকিত্সাব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ, এই বদলগুলো আনা হচ্ছে এনএইচএস-এ। শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর কাছে ‘চয়েস’ বড় কথা নয়। বড় কথা দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত রেফারাল,” বললেন রুথ। নতুন ব্যবস্থা মানতে না পেরে চাকরি ছেড়েছেন তিনি।
এ রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্তা, ডাক্তার, ফিল্ডকর্মীরা চাকরি ছেড়ে দেন না, তবে গা ছেড়ে দেন। যতই কাজ করো, কাজের কাজ হবে না, তা মনে মনে জেনে নিষ্প্রাণ, নিরর্থক কাজ করে যান। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী ছিল, আর ফল কী হল, তার কোনও মূল্যায়নও হয় না, কারও জবাবদিহিও চাওয়া হয় না। কেউ প্রশ্ন করতে গেলে উলটে ধমক খান - যা বলা হয়েছে করুন, অত জানার কী দরকার? শেষে শিশুমৃত্যু, প্রসূতিমৃত্যু, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গিতে মৃত্যু নিয়ে ফের প্রবল হইচই হলে নতুন একখানা প্রকল্প ঘোষণা হয়। উপরের চেয়ারে বসানো হয় নতুন লোক। ওতেই ভোট পাওয়া যায়।
কিন্তু নবজাতক, প্রসূতি বা স্ট্রোক-আক্রান্তের প্রাণ বাঁচানো যায় না। সীমিত টাকায় কী করে সেরা ফল দেওয়া যায় সর্বাধিক রোগীকে, সেটা জনমত ঠিক করতে পারে না। নেতা-নেত্রী কিংবা তাঁদের চামচে ডাক্তাররাও নয়। তার জন্য চাই সমীক্ষা-নিষ্কাশিত, পরীক্ষাসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যনীতি। আর চাই বুকের পাটা। জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও জনস্বার্থে কাজ করে যাওয়ার সাহস। |