প্রবন্ধ ১...
এই কূলে সরকার, ওই কূলে জনআন্দোলন
ক দিকে মনমোহন সিংহ, অন্য দিকে সনিয়া গাঁধী। এক দিকে সাউথ ব্লক আর যোজনা কমিশনে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া সহ উদারনৈতিক খোলা বাজারের উপাসকরা, অন্য দিকে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের (এন এ সি) জঁ দ্রেজ, হর্ষ মন্দর, অরুণা রায়ের মতো জনসামাজিক আন্দোলন ও তত্ত্বের পরিচিত মুখ। এক দিকে ক্ষমতাবান, দর্পী ‘ইন্ডিয়া’, অন্য দিকে প্রান্তিক তথা গ্রামীণ ‘ভারত’।
২০০৪ সালে ইউ পি এ-১ সরকার একটা প্রায়-অসম্ভবের প্রয়াসী হয়েছিল। দেশের প্রায়-বিপরীত ও চির-বিবদমান এই দুই মেরুর মধ্যে সংযোগ, সমন্বয় ও সংলাপের সেতু গড়ার চেষ্টা শুরু করেছিল। ন’বছর পরে, ২০১৩-তে সেতুটি ভেঙে পড়ার মুখে। অর্থনীতির শিক্ষক ও গ্রামীণ গরিবদের একশো দিনের সুনিশ্চিত কর্মসংস্থানের প্রকল্প এন আর ই জি এস-এর প্রধান রূপকার জঁ দ্রেজ আগেই পদত্যাগ করেছিলেন। হর্ষ মন্দরের মতো প্রাক্তন প্রশাসক ও রাজস্থানের মজদুর কিষান শক্তি সংগঠনের নেত্রী ও ‘তথ্যের অধিকার’-এর প্রধান প্রবক্তা অরুণা রায়। এর অর্থ, তথ্যের অধিকার থেকে একশো দিনের কাজ, কিংবা সংসদে পেশ-না-হওয়া খাদ্য সুরক্ষা বিল যে সব জনমুখী আইন বা কর্মসূচির সাফল্যকে সামনে রেখে কেন্দ্রের কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ-২ সরকার এই মুহূর্তে গণমাধ্যমে ‘ভারত নির্মাণ’ প্রচারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে, এবং যে বিষয়গুলিকে সামনে রেখে কংগ্রেস আগামী লোকসভা নির্বাচনে অবতীর্ণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে, শুরুর দিন থেকে সেগুলির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, সেই সব মানুষের প্রয়োজন আজ সরকারের ফুরিয়েছে।
অবশ্য গোড়া থেকেই সরকারি কর্তারা এন এ সি নিয়ে খুশি ছিলেন না, বিরোধীরাও নন। নীতিনির্ধারকদের চোখে এটা হল বাম বুদ্ধিজীবী ও ‘এনজিও’ওয়ালাদের আড্ডাখানা, যাদের কাজ হল, সরকারি কোষাগারের হাল না বুঝে র্যাডিকাল জনমোহনী ফর্দ-ফিরিস্তি পেশ করে ঘাটতির বহর আরও বাড়িয়ে চলা। তথ্যের অধিকারের ‘বাড়াবাড়ি’তে আমলাদের খুব খুশি হওয়ার কথা নয়। একশো দিনের কাজ বা খাদ্য সুরক্ষার ব্যাপারেও সরকারি চর্চায় বার বার আর্থিক ‘অসম্ভাব্যতা’র কথাই উঠে এসেছে। উল্টো দিকে, এন এ সি-র অনেকেও তাঁদের গৃহীত নীতি পুরোপুরি কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কথা বলেছেন। বিরোধীদেরও অনেক তেরছা সমালোচনা শোনা গেছে। ইউপিএ-১ সরকারের শুরু থেকে যাঁরা মনমোহন ও সনিয়ার মধ্যে ক্ষমতার দ্বৈত অস্তিত্বের কথা বলে এসেছেন, তাঁরা সেই যুক্তিতেই বলতে লাগলেন, সরকারের দু’টি ক্যাবিনেট— একটি নির্বাচিত ও সাংবিধানিক, যার নেতা প্রধানমন্ত্রী; অন্যটি অনির্বাচিত, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত— এনএসি, যার সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, যিনি কংগ্রেসেরও সর্বেসর্বা, যাঁর ইচ্ছেয় মনমোহনের প্রধানমন্ত্রিত্ব। অতএব এন এ সি-ই হল আসল ক্যাবিনেট!
হয়তো সমালোচনার সবটাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়, হয়তো মনমোহনের উদারবাদ আর সনিয়ার জনবাদ কংগ্রেসের পরিকল্পিত দুই মুখ যখন যেটা দেখাবার দরকার, তখন সেটা দেখানোই এই দু’টি সত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্য। হয়তো এ জাতীয় রটনাও ঠিক যে, উদারনৈতিক কঠোর সিদ্ধান্তের দায় মনমোহন সিংহের ওপর চাপিয়ে, সনিয়া তাঁর জনপ্রিয় জননেত্রীর ইমেজ অক্ষত রাখতে চান। হয়তো এ সবের দায় নিয়েই এক দিন মনমোহনকে সরে যেতে হবে, তখন হয়তো কংগ্রেস সরকারের সামনে নিয়ে আসবে রাহুল গাঁধীর অপরীক্ষিত, তরুণ মুখ। কিন্তু এই সব আকচাআকচির বাইরে গিয়ে যদি এই ‘দ্বৈততা’কে ধরতে চাই, তবে বুঝতে হবে এই সমস্যা আসলে ভারতীয় রাষ্ট্রের সমস্যা, যা তাকে জন্মাবধি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।
সহজ ভাবে বললে প্রশ্নটা হল, দেশের ‘বিকাশ’ মানে কি দেশের সব মানুষের বিকাশ? স্বাধীনতার আগে থেকে এ বিষয়ে নানা চর্চা চালু ছিল। বিভিন্ন মতের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও শুরুতে একটা বিষয়ে মোটামুটি ঐক্যমত্য ছিল: দেশের সব মানুষকে যত দূর সম্ভব বিকাশযজ্ঞে সংযুক্ত করতে হবে। মার্ক্সবাদীরা ভাবতেন শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে কৃষি ও শিল্পক্ষত্রের সর্বহারাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিপ্লব সংঘটনের কথা। কিন্তু ভারতের ‘মুখ্যধারা’র রাজনীতিতে তাঁরা কখনওই মুখ্য ভূমিকা নেননি, নিয়েছে কংগ্রেস। ফলে বিকাশকার্যে আমজনতাকে যুক্ত করার নীতিনির্ধারণের ব্যাপারে তাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। কংগ্রেসের মধ্যেও গাঁধীপন্থীরা চেয়েছেন বৃহত্‌ শিল্পের বদলে গ্রামভিত্তিক বিকেন্দ্রিত অর্থ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, পণ্যবাদী চাহিদার লাগাম দিতে। বল্লভভাই পটেলের মতো কেউ কেউ চেয়েছেন খোলা প্রতিযোগিতা। এঁদের মত অংশত সংবিধান ও সরকারি নীতিতে প্রতিফলিত হলেও সবচেয়ে জোরালো প্রভাব ফেলেছিলেন নেহরু। স্বাধীন ভারতের নতুন আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোটির তিনিই মূল প্রবক্তা ও রূপকার, যে মডেল প্রথম চারটি দশক জুড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
নেহরু ছিলেন গণতান্ত্রিক সামাজতন্ত্রী— সংসদীয় গণতন্ত্র ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক স্বাধীনতায় যেমন তীব্র বিশ্বাসী, তেমনি গাঁধীর বিপরীতে বৃহত্‌ ও দ্রুত শিল্পায়নের প্রবক্তা। এবং তিনি চেয়েছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শিল্প থাকলেও, বৃহত্‌ শিল্পের প্রধান অংশগুলিকে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তুলে পরিকল্পিত অর্থনীতি মারফত সমাজতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে। নতুন অর্থনীতির পাশাপাশি তখন নতুন রাজনীতির হাতেখড়ি চলছিল। এত ছোট-বড় অঞ্চল/জাতপাতভিত্তিক দল ছিল না। মূলত কংগ্রেসের মধ্যেই ভারতের নানা অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীগুলির স্বার্থ-সমন্বয়ের চেষ্টা করা হত। নেহরুর মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যে কংগ্রেসের প্রধান্যে গড়া এই রাজনৈতিক ‘ঐক্য’র মডেলটি ধাক্কা খেতে লাগল, কিন্তু আর্থিক ক্ষেত্রে নেহরুবাদী দিশা পাল্টাল না, বরং নেহরু-তনয়া ইন্দিরা গাঁধী আরও র্যাডিকাল অবস্থান নিয়ে ব্যাঙ্ক ও কয়লা ক্ষেত্রের জাতীয়করণ করে এবং গরিবদের অভিমুখী ২০ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে, তাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করলেন।
রাজীব গাঁধীর সময়ে ‘বিশ্বায়নমুখী’ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু নেহরু-ইন্দিরার আর্থিক ব্যবস্থাটি আসল ধাক্কা খেল নরসিংহ রাওয়ের আমলে। ’৯০ দশকের গোড়ার সেই টালমাটাল সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ সমাজতন্ত্রী দেশগুলির দুদ্দাড় পতনের মধ্যেই প্রবল হয়ে উঠল নব্য উদারবাদী খোলাবাজারের বিশ্বায়নের দাবি। শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হল, পুঁজিবাদে উত্তরণের মধ্যেই ঘটেছে ‘ইতিহাসের পরিশেষ’, এর ‘বাইরে’ ইতিহাসের আর কোথাও যাবার নেই। সেই লগ্নেই অলাভজনক উদ্যোগ ও জনমোহনী প্রকল্পগুলি থেকে সরকারি হাত ‘গুটিয়ে নেওয়া’র পালা শুরু, সারা বিশ্বে, ভারতেও। এই প্রবণতা তুঙ্গে পৌঁছল বাজপেয়ীর সময়ে। এক দিকে ঝাঁ-চকচকে সুবর্ণ-চতুর্ভুজ রাস্তায় ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ ও অন্য দিকে ধুঁকতে থাকা দেশের মধ্য-নিম্ন ও প্রান্তিক অংশের তফাত বাড়তে লাগল। ২০০৪-এ এনডিএ-কে সরিয়ে ইউপিএ-১ ক্ষমতায় এল। এই প্রেক্ষিতেই সেই সময় কংগ্রেসের তথা সরকারের বিকাশের ‘মানবিক মুখ’ টিকিয়ে রাখার অঙ্গীকার, যার সূত্রে সে দিন গঠিত হয়েছিল জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ।
ইউপিএ-র এই ‘মানবিক বিকাশ’ মানে কিন্তু আগেকার সরকারি সমাজবাদে ফিরে যাওয়া নয়, বিশ্বায়নকেও অস্বীকার করা নয়। এই ‘মানবিক মুখ’-এর অর্থ— বিশ্বায়িত অর্থনীতিকে তার নিজস্ব ক্ষেত্রে (কর্পোরেট ও অন্যান্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে) স্বাধীন ভাবে খেলতে দিয়ে, মধ্যবিত্ত ও মুখ্যত ‘গরিব’দের (গরিবদের ‘গরিব’ বা ‘পুওর’ বলাই এ কালের অর্থনীতির দস্তুর) জন্য জীবনধারণের অধিকার সহ অন্য কিছু প্রাথমিক অধিকার ‘সুনিশ্চিত’ রাখা। হয়তো এটা একই সঙ্গে ‘শ্যাম’ ও ‘কুল’ টিকিয়ে রাখার নীতি। কিন্তু যখন কোনও জাদুদণ্ডে রাতারাতি সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের অবস্থা ফেরার সম্ভাবনা নেই, যখন দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছে, যখন জাতীয় রাজনীতি ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন, পার্লামেন্ট) ওপর কারওই নিয়ন্ত্রণ নেই, তখন এ হেন ‘কঠিন’ পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে জন-আন্দোলনের মানুষদের ক্রমশ বিচ্ছেদ কি বৃহত্তর সমাজে কোনও ভুল বার্তা দেবে না, আগামী ভোটের ঋতুতে?

শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.