|
|
|
|
শিকেয় এনসিটিসি |
মুখ্যমন্ত্রীদের মঞ্চ থেকেও নিশানা তাঁর দিল্লি দখল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
বিষয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। মঞ্চ, মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন। সেখানে সন্ত্রাসবাদী হামলা ও মাওবাদী আক্রমণ মোকাবিলার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে, এমনটাই আশা করা যেতে পারত। কিন্তু ছবিটা বদলে দিলেন এক জন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি দখলের স্বপ্ন নিয়ে বিজ্ঞান ভবনে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনেই লোকসভা ভোটের দামামা বাজিয়ে দিলেন তিনি। নিজের রাজ্যে উপনির্বাচনে কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মোদী ইউপিএ সরকারের কাজের ফিরিস্তি দাবি করলেন মনমোহন সিংহের কাছে। যার জবাব দিতে মাঠে নামতে হল দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পি চিদম্বরম ও মণীশ তিওয়ারিকে। যদিও শেষ রক্ষা হল না। মোদী-সহ অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের আপত্তিতে জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) গড়া নিয়ে সরকারের সংশোধিত প্রস্তাবও কার্যত হিমঘরেই পাঠাতে হল সরকারকে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে এসে আগেও মোদী কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন। আজ কিন্তু সেখানেই না থেমে এই সম্মেলনকেই ইউপিএ সরকারের শেষ মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলন আখ্যা দেন তিনি। বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে অন্য রাজ্যের হয়েও সওয়াল করেন কেন্দ্রের কাছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সম্মেলনের শুরুতে সন্ত্রাসবাদ ও মাওবাদী মোকাবিলায় কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার কথা বলার পরেই আক্রমণে নেমে পড়েন মোদী। মনমোহনের সামনেই দাবি তোলেন, “গত দশ বছরে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতিতে ইউপিএ সরকার কী করেছে, তা জানিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক।” মোদীর অভিযোগ, প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে কেবল নানা রকম পরামর্শ দেওয়া হয়। কাজের কাজ কিছু হয় না। গত এক দশকে কোন পরামর্শটা কার্যকর হয়েছে, তা জানাক ইউপিএ। |
|
আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে মোদী। ছবি: এপি |
এনসিটিসি-কে কোনও রাজ্যে গিয়ে তল্লাশি অভিযান চালানো বা গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপত্তি জানান নীতীশ কুমার ও বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রীরাও। বাধার মুখে পিছু হঠে কেন্দ্র এনসিটিসি-কে ওই ক্ষমতা না দেওয়া ও এটিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এর পরেও মোদী আজ কড়া বিরোধিতা করেন এনসিটিসি-র। তাঁর সাফ দাবি, এনসিটিসি-কে পাকাপাকি ভাবে হিমঘরে পাঠাক কেন্দ্র। কারণ এই পরিকল্পনাটাই ভুল। তামিলনাড়ুর তরফেও এনসিটিসি-র সরাসরি বিরোধিতা করা হয়। সম্মেলনের শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, “রাজ্যগুলিকে নিয়ে সর্বসম্মতি না হওয়া পর্যন্ত এনসিটিসি নিয়ে সরকার এগোবে না।
উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের দিনে মোদী যে মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনকেই রাজনৈতিক আক্রমণের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করবেন, তা আগে থেকেই আঁচ করেছিল মনমোহন সরকার তথা কংগ্রেস। সম্মেলনে মোদীর বক্তব্যে আক্রমণের আঁচ পেয়েই তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি দ্রুত বিজ্ঞান ভবনে চলে আসেন। সম্মেলনের বিরতিতে মোদী সাংবাদিক বৈঠক করে ইউপিএ-কে প্রকাশ্যে নিশানা করেন। এর পরেই মোদীকে পাল্টা আক্রমণ করতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন চিদম্বরম ও মণীশ। শ্বেতপত্রের দাবি উড়িয়ে দিয়ে এনসিটিসি প্রসঙ্গে তাঁর আপত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। চিদম্বরম বলেন, “দু’জন মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতায় আমি শঙ্কিত। এর ফল ভুগতে হবে। এনসিটিসি না হলে সন্ত্রাসবাদে ফের রক্তাক্ত হতে হবে দেশকে।”
মোদীর অভিযোগ ছিল, ক্রিকেট গড়াপেটা রুখতে কেন্দ্র তড়িঘড়ি আইন করতে পারে, কিন্তু সন্ত্রাস মোকাবিলায় কোনও আইন তৈরি করতে পারেনি। এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে চিদম্বরম বলেন, “২০০৮ সালে ২৬/১১-র হামলার পরেই বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) সংশোধন করে তাকে আরও কঠোর করা হয়েছে। চিদম্বরম বলেন, “আসলে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী চান টাডা, পোটা ফেরত আনতে। সেটা তিনি সরাসরি বলছেন না কেন? কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধে। ইউএপিএ সংশোধনের সময়ও বিজেপি পোটা-র কিছু অংশ ঢোকাতে চেয়েছিল।”
চিদম্বরম যা-ই বলুন, এনসিটিসি নিয়ে অন্য মুখ্যমন্ত্রীরাও যে কেন্দ্রের সঙ্গে একমত, তা নয়। অমিত মিত্র পশ্চিমবঙ্গের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতার যে বিবৃতি পেশ করেছেন, তাতেও বলা হয়েছে, এনসিটিসি নিয়ে বর্তমান প্রস্তাবও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। রমন সিংহ, নীতীশ কুমারের মতো অনেকেই দাবি করেন, সংসদে আইন এনে এনসিটিসি গঠন হোক। এনসিটিসি-র অপব্যবহারের পথ বন্ধ করা দাবি তোলে মহারাষ্ট্র, কর্নাটকের মতো কংগ্রেস শাসিত রাজ্যও।
মুম্বইয়ে ২৬/১১-র হামলার পরে এনসিটিসি-র পরিকল্পনা করেছিলেন চিদম্বরমই। উদ্দেশ্য ছিল, কোথাও সন্ত্রাসবাদী হানা হলে বা তার আশঙ্কা দেখা দিলে রাজ্য সরকারের অপেক্ষা না করে কেন্দ্র নিজেই হস্তক্ষেপ করবে। নিজের যুক্তিতে অনড় থেকেই রাজ্যগুলির আপত্তি প্রশমণে চিদম্বরম আজ যুক্তি দেন, মুম্বই-সন্ত্রাসের মতো বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে মাঠে নামতেই হবে। কিন্তু এনসিটিসি-র সেই ক্ষমতা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে এর গুরুত্ব এমনিতেই কমে গিয়েছে। এখনও এর বিরোধিতা অযৌক্তিক। যদিও সম্মেলনের শেষে শিন্দের ঘোষণায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এনসিটিসি-কে হিমঘরে পাঠানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই।
চিদম্বরম আজ ধরে-ধরে মোদীর বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেওয়ার চেষ্টা চালান। মোদী এ দিন অভিযোগ তোলেন, মুখে দেশের নিরাপত্তার কথা বললেও ইউপিএ সরকার আসলে রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাই বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোদীর ইঙ্গিত ছিল ইশরাত জহানের ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় সিবিআই তদন্তের দিকে। রাজ্য প্রশাসনের দাবি, গুজরাত পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছিল সন্দেহভাজন লস্কর জঙ্গি ইশরাতের। কিন্ত ভুয়ো সংঘর্ষের অভিযোগ ওঠায় আদালতের নির্দেশে সিবিআই তার তদন্ত করছে। এ নিয়ে অরুণ জেটলির মতো বিজেপি
নেতারা বলছেন, আসলে ইউপিএ সরকার মোদী-আতঙ্কে ভুগছে। চিদম্বরম আজ পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেন, “মোদী এবং বিজেপি নেতারা এ সব বলে সিবিআই তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।”
মোদী এ দিন অভিযোগ করেন, “সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় বাৎসরিক মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলন প্রথামাফিক বৈঠক হয়ে দাঁড়িয়েছে।” জবাবে চিদম্বরম বলেন, “এই সব বলে অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের অংশগ্রহণকেও খাটো করছেন মোদী। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তার উল্টো চেষ্টাটাই করেছেন সম্মেলনে। অন্য রাজ্যের হয়েও তিনি তোপ দেগেছেন কেন্দ্রকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিন্দে ত্রিপুরা ও মিজোরাম সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে রিয়াং শরণার্থী সমস্যা মিটিয়ে ফেলার অনুরোধ করেন। মোদীর প্রশ্ন, “সরকারিয়া কমিশনের সুপারিশ মেনে আন্তঃরাজ্য বিরোধ মেটানোর মতো কোনও ব্যবস্থা তৈরি করেনি কেন্দ্র। দু’রাজ্যে দু’টি ভিন্ন দলের সরকার কী ভাবে এখন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে?” মোদীর বার্তাটা স্পষ্ট, গুজরাত তাঁর বর্তমান, গোটা দেশ তাঁর ভবিষ্যত নিজেকে এ ভাবেই ক্রমশ মেলে ধরতে চান তিনি।
|
পুরনো খবর: এনসিটিসি নিয়ে আপত্তি মেটাতে মরিয়া কেন্দ্র |
|
|
|
|
|