|
|
|
|
সিট করছেটা কী, প্রশ্ন পুলিশেই
শিবাজী দে সরকার • কলকাতা |
সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু হয়েছে ১৬ এপ্রিল। কিন্তু খাস কলকাতার ঢাকুরিয়ায় সারদার অফিসে তল্লাশি চালানো হল তার প্রায় দেড় মাসের মাথায়, ৩০ মে। পুলিশমহলেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এত দেরি? ১৬ এপ্রিল যারা তদন্তে নামে, সেই বিধাননগর কমিশনারেট কলকাতা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ঢাকুরিয়ার অফিসে আগেই হানা দিল না কেন?
এই সব প্রশ্নের মূলে আছে একটা বৃহত্তর প্রশ্ন। সেটা হল, স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) বা বিশেষ তদন্তকারী দল কী করছে?
সারদা কেলেঙ্কারির মতো বিরাট তছরুপের তদন্তের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ২৬ এপ্রিল সিট তৈরি করে দেন। রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নেতৃত্বাধীন ওই দলে কলকাতা পুলিশ, সিআইডি, বিধাননগর কমিশনারেট সকলকেই রাখা হয়। ঠিক হয়, সব তদন্তকারী সংস্থা সিটের অধীনে থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বিধাননগর কমিশনারেট, দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশ এবং কলকাতা পুলিশ নিজের নিজের মতো তদন্ত করছে। সমন্বয়ের লেশমাত্র নেই। ঢাকুরিয়ায় সারদার অফিস থেকে ২৫টি কম্পিউটার আটকের ঘটনা সিটের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। |
|
৩৮/৩এ গড়িয়াহাট রোড, ঢাকুরিয়ায় একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ভবনের মাথায় তেতলা জুড়ে সারদার অফিস। বৃহস্পতিবার বিকেলে সেই অফিসে হানা দিয়ে ২৫টি কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করে কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ। কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীদের দাবি, ওই সব কম্পিউটারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। তাতে সারদা-কাণ্ডের বেশ কিছু রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। শুধু পুলিশের একাংশ নয়, এক শ্রেণির আইনজীবীও বলছেন, তদন্ত শুরুর পরে পরেই ঢাকুরিয়া-সহ রাজ্যের সর্বত্র সারদার সব অফিসে হানা দিয়ে যাবতীয় নথিপত্র আটক করলে ইতিমধ্যেই অনেক তথ্য পাওয়া যেত। কিন্তু এক মাসেও সিট যে সতিক্যারের সমন্বয়কারী সংস্থা হয়ে উঠতে পারেনি, তারা যে তদন্তের কাজ আরও পিছিয়ে দিচ্ছে এবং এর ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি হারিয়ে যাচ্ছে, সেই অভিযোগ তুলেছেন কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার আইনজীবীরা।
দীর্ঘ সময় পেয়েছিল বিধাননগর কমিশনারেট। প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু ঢাকুরিয়ার ওই অফিস কী ভাবে তাদের নজর এড়িয়ে গেল? সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে হাতে পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশ ঢাকুরিয়ার অফিসে হানা দিয়ে ২৫টি কম্পিউটার আটক করল কী ভাবে?
বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, “আমরা শুধু আমাদের নিজেদের এলাকাতেই তদন্ত করেছি। অন্য সব সংস্থার নিজেদের মতো তদন্ত চালানোর স্বাধীনতা রয়েছে। তারা তাদের মতো করে কাজ করছে।”
কিন্তু সিট গড়ার পরে আলাদা আলাদা তদন্ত করার মানে কী?
বিধাননগর কমিশনারেটের ওই কর্তার মন্তব্য, “সকলকে নিয়ে একসঙ্গে তদন্ত চালানোর মতো পরিস্থিতি এখনও আসেনি।”
গোটা রাজ্যে সারদা-কর্ণধারের বিরুদ্ধে অন্তত ২০০টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ ভাবে ধাপে ধাপে তদন্ত চললে তা কবে শেষ হবে, আদৌ হবে কি না, কেউ জানে না। এখনও সারদার মোট আমানতের পরিমাণও হিসেব করে উঠতে পারেনি পুলিশ। বস্তুত, সারদার জাল বিভিন্ন রাজ্যে ছড়ানো থাকলেও তদন্তভার সিবিআই-কে দিতে আপত্তি করে আসছে রাজ্য সরকার। রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ বা সিআইডি-র হাতেও তদন্তভার দেওয়া হয়নি। তার বদলে রাজ্য পুলিশ, কলকাতা পুলিশ ও সিআইডি-র কয়েক জন আইপিএস অফিসারকে দিয়ে সিট গড়া হয়েছে, যারা তদন্তের দেখভাল করবে।
রাজ্য পুলিশের একাংশের বক্তব্য, বিক্ষিপ্ত ভাবে অভিযান চালানোর বদলে একটি নির্দিষ্ট তদন্তকারী সংস্থার হাতে গোটা বিষয়টি থাকলে দ্রুত কাজ হত। এক রাজ্য গোয়েন্দা-কর্তার মতে, “সারদা-কর্ণধারের বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ আনা হয়েছে, সব ক’টিই প্রতারণার (৪০৬, ৪০৯ ও ৪২০ ধারায়)। তাই একটি সংস্থার পক্ষে তদন্তে অসুবিধে ছিল না।”
তার বদলে কতটুকু তদন্ত হয়েছে?
মাত্র তিনটি এলাকায় সারদার অফিসে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ সুদীপ্ত এবং সারদার অন্যতম কর্ত্রী দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে নিজেদের হেফাজতে রেখে ওই তল্লাটের অফিসগুলিতে তল্লাশি চালিয়েছিল। তার পরে বারুইপুর থানার পুলিশ কামালগাজিতে সারদার একটি জমির হদিস পায়। বিষ্ণুপুরে সারদা গার্ডেনের নামে আবাসন প্রকল্পের জমিতেও তল্লাশি চালানো হয়। এর পরেই কলকাতা পুলিশ গড়িয়াহাটের অফিসে হানা দেয়। এক পুলিশকর্তার কথায়, “জেলায় জেলায় সারদার বিভিন্ন অফিসে ঢুঁ মারতে গেলে তো দেখছি, সুদীপ্তদের বিভিন্ন এলাকার পুলিশের হেফাজতে নিতে হবে! ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ, সন্দেহ নেই।”
আটক হার্ড ডিস্ক ও অন্যান্য নথি খুঁটিয়ে দেখার কাজও বাকি। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “হার্ড ডিস্ক ঘাঁটাঘাঁটির পরিকাঠামোয় কলকাতা পুলিশ ঢের এগিয়ে। আমাদের নিজস্ব সাইবার ল্যাব আছে। কিন্তু বিধাননগর পুলিশ তো আমাদের সাহায্য চায়নি। ওরাও তো আগে সল্টলেকের অফিস থেকে বেশ কিছু কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করেছিল।” এই অবস্থায় সামগ্রিক ভাবে তদন্ত-প্রক্রিয়ার সমন্বয় নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
এই পরিস্থিতিতে অভিযুক্তদের তরফে অহেতুক হয়রানির অভিযোগ আনা হয়েছে। দেবযানীর আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা শুক্রবার বলেন, “এক-একটা তদন্ত সংস্থা আমার মক্কেলকে হেফাজতে নিচ্ছে আর শাটল ককের মতো তাঁকে নিয়ে বারুইপুর, নিউ টাউন, লালবাজারে ঘোরাফেরা করছে। এর পরে তাঁকে হয়তো নিয়ে যাওয়া হবে শিলিগুড়ি, বর্ধমানেও। একসঙ্গে সব অভিযোগের তদন্তের দাবিতে আমরা হাইকোর্টে যাব।”
সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চেয়ে দায়ের করা মামলার আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “আমরা আগেই বলেছিলাম, মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সিট তৈরি করা হয়েছে। সরকার যে সুদীপ্তকে বাঁচাতেই সিট তৈরি করেছে, তা পরিষ্কার। আমরা হাইকোর্টে আগেই তা জানিয়েছিলাম। গ্রীষ্মাবকাশের পরে হাইকোর্ট খুলবে আগামী সপ্তাহে। সেখানে আমরা ফের সব জানাব।” সুব্রতবাবুর অভিযোগ, প্রতিটি সংস্থা আলাদা ভাবে তদন্ত চালিয়ে আসলে যে অভিযুক্তদেরই সাহায্য করছে, সেটাই হাইকোর্টে জানানো হবে। এই তদন্তে কেন সিবিআই-কে দরকার, সেটাই তুলে ধরা হবে উচ্চ আদালতে।
|
পুরনো খবর: সিবিআই রাজি সারদায়, চাপে তৃণমূল |
|
|
|
|
|