সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত নিয়ে ক্রমেই চাপ বাড়ছে রাজ্য সরকারের উপর। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক, দু’ভাবেই।
মঙ্গলবারই কলকাতা হাইকোর্টে হলফনামা দাখিল করে সিবিআই জানিয়ে দিয়েছে, আদালত নির্দেশ দিলে তদন্ত করতে তাদের কোনও আপত্তি নেই। এই হলফনামা পাওয়ার পরে আজ, বুধবারই হাইকোর্ট এই সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলার রায় দিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্ত চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে অসম সরকার। এ দিন রাজ্যে অভিযুক্ত লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ত্রিপুরাও। সমস্ত তথ্য দু’এক দিনের মধ্যেই সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার।
একের পর এক রাজ্য সরকার সিবিআইয়ের দ্বারস্থ হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই চাপ বাড়ছে মমতার সরকারের উপরে। সেই চাপ আরও বাড়াতে আগামিকাল, বৃহস্পতিবার দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে বাম প্রতিনিধিদল। সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত-সহ এক গুচ্ছ দাবিতে। মঙ্গলবার বামফ্রন্টের বৈঠকে আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্তও হয়েছে। |
সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব সিপিএম। মঙ্গলবার শ্যামবাজারের জনসভায়।—নিজস্ব চিত্র। |
সারদা কাণ্ডে সিবিআই মামলা চেয়ে জনস্বার্থের মামলায় রাজ্য সরকার যে হলফনামা জমা দিয়েছে, তাতে অবশ্য বলা হয়েছে, পুলিশি তদন্ত যে ভাবে চলছে তাতে এখন সিবিআই তদন্তের কোনও প্রয়োজন নেই। এ ব্যাপারে সিবিআইয়ের বক্তব্যও জানতে চেয়েছিল আদালত। সিবিআইয়ের তরফে আগেই বলা হয়েছিল, আদালত চাইলে তাদের তদন্ত করতে কোনও আপত্তি নেই। এ দিন প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর এজলাসে জমা দেওয়া হলফনামায় সিবিআইয়ের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখার এসপি রঞ্জন বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘মহামান্য আদালত সারদা-কাণ্ডের তদন্তভার তাদের উপরে অর্পণ করলে সিবিআইয়ের কোনও আপত্তি নেই। তবে তদন্তের সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্য রাজ্য সরকার যাতে যথেষ্ট সংখ্যক কর্মী (সিবিআই যা চাইবে) ও অন্য পরিকাঠামো (তদন্তের স্বার্থে) সরবরাহ করে, সে বিষয়ে হাইকোর্টকে নির্দেশিকা জারি করতে হবে’। |
টাকা ফেরতের আশায়। নথি জমা দিতে ভিড় কমিশনে। —নিজস্ব চিত্র। |
সিবিআই সূত্র জানাচ্ছে, অসমে তদন্তের প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। এক সিবিআই কর্তার কথায়, “অসমে তদন্ত শুরু করার আগে গুয়াহাটির কোনও একটি থানায় আমরা মামলা দায়ের করব। সেখানে সুদীপ্ত সেনকেই মূল অভিযুক্ত দেখানো হবে। যে হেতু সারদার সদর দফতর কলকাতায়, তাই তদন্তের কাজে অসমের সিবিআই দলকে কলকাতায় আসতেই হবে। এ রাজ্যের তদন্তকারী সংস্থা সাহায্য না করলে আমরা গুয়াহাটি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হব।”
তৃণমূল এবং রাজ্য সরকার অবশ্য এখনও সিবিআই-বিরোধিতার অবস্থানে অনড়। তৃণমূল মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, নন্দীগ্রাম বা নেতাই কাণ্ডের পরে কেন বাম সরকার সিবিআই তদন্তে রাজি হয়নি? যার জবাবে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “নন্দীগ্রাম বা নেতাইয়ের ঘটনা ছিল আইনশৃঙ্খলার বিষয়। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। সেই কারণেই রাজ্য সিবিআই চায়নি।”এ দিনই উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরে (দু’দিন আগে যে মাঠে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেবরা সভা করেছিলেন, সেখানেই) সভা করে মুকুল রায় ও সুব্রত বক্সী বলেন, “আত্মরক্ষার জন্য কংগ্রেস এবং সিপিএম সিবিআই চাইছে! কারণ, ওদের দলের অনেক নেতাই এই চিট ফান্ড কাণ্ডে জড়িত। মানুষ জানেন, সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা কোথায়? যেখানে সিবিআই প্রধান নিজেই বলছেন, তাঁরা সরকারি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন, সেই সিবিআই-কেই ওঁরা চাইছেন!”
আবার শ্যামবাজারে মমতার পাল্টা সভায় সিবিআই তদন্তের পাশাপাশি সর্বদল বৈঠক ডাকারও দাবি তুলেছে সিপিএম। কলকাতা পুরসভার অনুষ্ঠান রয়েছে, এই যুক্তিতে মমতা ঠিক যেখানে সভা করেছিলেন, সেখানে সিপিএম-কে সভা করার অনুমতি দেয়নি পুলিশ। শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর সামনে ম্যাটাডোরকে মঞ্চ করে সভা করে তারা। সেখানে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব বলেন, “আমরা সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত দাবি করছি। প্রতিদিন বহু মানুষ আত্মহত্যা করছেন। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী বাংলার স্বার্থে সর্বদল বৈঠক ডাকুন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অশোক ঘোষ, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য সকলকে ডেকে পরামর্শ নিন।”
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, তারা কেবল সারদা-কাণ্ডের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় না। ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারী এবং এজেন্টদের পাশেও দাঁড়াতে চায়। সেই কারণেই সর্বদল বৈঠকের প্রস্তাব। গৌতমবাবুর কথায়, “সর্বদল বৈঠক ডাকলে মানুষের কাছে একটা বার্তা যাবে। রাজনীতি তো হচ্ছেই! কিন্তু মানুষের কথাও ভাবুন।” এ কথা বললেও তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও কিছু কম করেননি সিপিএম নেতারা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম যেমন বলেন, “পরিবর্তনের মুখ হিসেবে যাঁরা বামফ্রন্টকে হঠাতে নেমেছিলেন, তাঁদের বাড়িতে তল্লাশি করতে হবে। তা হলেও সারদার টাকা উদ্ধার করা যাবে।”
সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের পাশাপাশি ছাত্র নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি-সহ ৭ দফা দাবিতে এক গুচ্ছ আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট। ২৭-২৯ মে জেলার কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস, ডাকঘরের সামনে ৪ ঘণ্টা করে অবস্থান করা হবে। কলকাতায় ৩১ মে কেন্দ্রীয় ভাবে আইন-অমান্য হবে। যেখানে অংশ নেবেন রাজ্যের বাম নেতারা।
বামেদের পাশাপাশি আসরে নেমেছে বিজেপি-ও। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত এবং সেবি-র পাঠানো তালিকাভুক্ত ৭৩টি সংস্থা গুটিয়ে না-দিয়ে কেবল তাদের আর্থিক অন্যায় বন্ধ করার দাবিতে এ দিন রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, ওই ৭৩টি সংস্থা বন্ধ হয়ে গেলে রাজ্যে নতুন করে বিরাট বেকার বাহিনী তৈরি হবে। আত্মহত্যা বাড়বে এবং আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি হবে। তাই ওই সংস্থাগুলির কর্মীদের চাকরি বাঁচিয়ে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। |