সংশয় ছিলই। তাতে বাড়তি মাত্রা দিল গ্রিন বেঞ্চ। পরিবেশ সংক্রান্ত আদালতটি জানিয়েছে, দূষণ হতে পারে বলে নয়াচরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না। গ্রিন বেঞ্চের এই নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। শুক্রবার হাইকোর্টে এই সংক্রান্ত একটি মামলার শেষে আবেদনকারীদের আইনজীবী কৌশিক চন্দ বলেন, “গ্রিন বেঞ্চের নিষেধাজ্ঞা হাইকোর্টে জমা পড়েছে।” এখন হাইকোর্টে গ্রীষ্মকালীন ছুটি। ছুটির পর ফের মামলাটি উঠবে।
পূর্ব মেদিনীপুরের নয়াচরে ‘পরিবেশ বান্ধব’ বিদ্যুৎ কেন্দ্র (সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার) করার কথা অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের সংস্থা ইউনিভার্সাল সাকসেস সংস্থার। প্রস্তাব অনুযায়ী, সেখানে দু’টি পর্যায়ে ২০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হবে। এর মধ্যে প্রথমটি চালু হওয়ার কথা (১৩২০ মেগাওয়াট) ২০১৬ সালে। দ্বিতীয়টি (৬৮০ মেগাওয়াট) ২০১৮-এ। ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১০০০ একর জমি দরকার।
কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি তোলে পরিবেশ মন্ত্রক। বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে আপত্তি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেন নয়াচরে বসবাসকারী মৎস্যচাষিরা। তাঁদের বক্তব্য, ওই এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে দূষণের জেরে নয়াচরের ক্ষতি হবে। সরকারের অবশ্য বক্তব্য ছিল, সিঙ্গাপুরে জুরং আইল্যান্ডেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। তাতে পরিবেশের কোনও সমস্যা হয়নি।
এই বিতর্কের মধ্যে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ বিভিন্ন সংস্থার মতামত জানতে চায়। সেই মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই) একটি রিপোর্ট দিয়ে হাইকোর্টকে জানায়, নয়াচরে নদীর মোহনা অঞ্চলের মাটি খুব কাঁচা। তাই ওখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলে তা তলিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়াও রয়েছে দূষণের সম্ভবনা। জিএসআইয়ের কাছ থেকে রিপোর্ট পেলেও দ্বিতীয় একটি মতামত নেওয়ার জন্য ডিভিশন বেঞ্চ বিষয়টি গ্রিন বেঞ্চের কাছে পাঠিয়েছিল। তাদের রিপোর্ট জমা পড়ে পরিবেশ মন্ত্রকে। পরিবেশ মন্ত্রক তা পাঠিয়ে দিয়েছে হাইকোর্টের কাছে। এই রিপোর্টেও আপত্তি জানানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন রাজ্য সরকারের অধীন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদেরই আইনজীবীর।
হাইকোর্টের মামলা নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ এখনও রায় দেয়নি। কিন্তু প্রায় দু’বছর আগের ঘোষিত প্রকল্পকে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক অনুমোদন না-দেওয়ায় নয়াচরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার সম্ভাবনা যে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে, তা আগেই বুঝেছিল রাজ্য সরকার এবং ইউনিভার্সাল সাকসেস। এই কারণেই ‘বিকল্প’ হিসাবে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে রাজ্য সরকারের শিল্পতালুকে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে আগ্রহ প্রকাশ করে নির্মাণকারী সংস্থা। তাতে সিলমোহর দেয় রাজ্য সরকার।
তবে কী নয়াচরের বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হয়ে গিয়েছে?
রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “এর অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। তারা বাতিল করার কথা জানায়নি।” তবে কেন রঘুনাথপুরে জমি দেওয়া হল ইউনির্ভাসাল সাকসেস-কে? পার্থ বলেন, “নয়াচরে এখনও অনুমতি পাওয়া যায়নি বলেই রঘুনাথপুরে জমি দেওয়া হচ্ছে।”
প্রকল্পের কর্ণধার প্রসূনবাবু বলেছেন, “নয়াচরের বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পরিবেশ-বিশেষজ্ঞরা একটি রিপোর্ট দিয়েছেন। দিল্লির কাছে তা পাঠানো হয়েছে।” পার্থবাবু বলেন, “পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় কেন্দ্রের এক প্রতিনিধি দল দ্বিতীয় বার নয়াচর পরিদর্শন করেছে। পাশাপাশি, রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের অধীনে পরিবেশবিদরা একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে, যা কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।”
রঘুনাথপুরের প্রস্তাবিত প্রকল্পের আয়তনও অবশ্য ছেঁটে দিয়েছে ইউনিভার্সাল সংস্থা। বৃহস্পতিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে প্রসূনবাবু জানান, দামোদরের জল পেতে সমস্যা হতে পারে। তাই রঘুনাথপুরে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ওখানে ১৩২০ মেগাওয়াটের (দু’টি ইউনিট) তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার কথা ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা কমিয়ে ৬৬০ মেগাওয়াট করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য রঘুনাথপুরে ৭০০ একর জমি দিতে রাজি হয়েছে রাজ্য। প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার প্রকল্পটির আয়তন অর্ধেক হয়ে যাওয়ায় এখন ৫০০ একর জমি পেলেই কাজ চলবে।
|