দিন বদলালেও জেলাবিন্যাসে অনড়ই রইল রাজ্য। এবং নিজেদের প্রস্তাবিত ৯-৪-৪ এর ছক মেনেই সোমবার পঞ্চায়েত ভোটের জন্য আর এক দফা বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিল তারা। এই সূচি মানলে প্রথম দফায় ভোট হবে ৯টি জেলায়। যার জন্য প্রয়োজন ১২০০ কোম্পানি বাহিনী। অর্থাৎ, ১ লক্ষ ২০ হাজার নিরাপত্তারক্ষী। এই হিসেব হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশিকা মেনে। কিন্তু রাজ্যের হাতে রয়েছে ৪৫০ কোম্পানি। ভিন রাজ্য থেকে এখনও পর্যন্ত মাত্র ১৫ কোম্পানি পুলিশ পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। তা হলে অতিরিক্ত ৭৩৫ কোম্পানি নিরাপত্তা বাহিনী কোথা থেকে আসবে? মহাকরণের কাছে এই প্রশ্নই করেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে।
নিরাপত্তার বন্দোবস্ত কী হবে, তা ঠিক করতে এ দিনই স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় এবং এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসু নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পরেও পুলিশ মোতায়েন নিয়ে জট কাটাতে সমাধানসূত্র বেরোয়নি।
কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাদের নির্দেশে বুথগুলিকে চার ভাগ করেছিল। অতি-স্পর্শকাতর বুথের জন্য দু’জন সশস্ত্র পুলিশ এবং দু’জন কনস্টেবল, স্পর্শকাতরের জন্য দু’জন সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কম স্পর্শকাতরের ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্র (যেখানে একাধিক বুথ থাকতে পারে) প্রতি এক জন সশস্ত্র পুলিশ ও এক জন কনস্টেবল আর সাধারণের ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্র প্রতি এক জন সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করার কথাও বলা হয়। |
নজরে ৯ |
জেলা |
মোট বুথ |
বিশেষ বুথ |
% |
দঃ ২৪ পরগনা |
৫৭০১ |
৫০৮৫ |
৮৯ |
উঃ ২৪ পরগনা |
৪২০৫ |
৩৬১৫ |
৮৬ |
হাওড়া |
২৯৩৮ |
১৬৭৬ |
৫৭ |
হুগলি |
৩৭৬৯ |
১৮২৭ |
৪৯ |
পূর্ব মেদিনীপুর |
৩৯৭৭ |
৩১৫৮ |
৭৯ |
পশ্চিম মেদিনীপুর |
৪৭৩৭ |
৩১৩১ |
৬৬ |
বাঁকুড়া |
৩০১০ |
১০০৪ |
৩৩ |
পুরুলিয়া |
২২৮৭ |
১০০১ |
৪৪ |
বর্ধমান |
৫৬০৪ |
৩২৮৫ |
৫৯ |
• রাজ্য চায়, এই ৯ জেলায় এক দিনে ভোট হোক
• সে ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী চাই ১.২০ লক্ষ রক্ষী
• রাজ্যের হাতে আছে ৪৫ হাজার
• আনতে হবে ৭৫ হাজার
• ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, অসম থেকে মিলতে পারে ১৫০০ |
(অতিস্পর্শকাতর ও স্পর্শকাতর মিলে বিশেষ বুথ) |
|
হাইকোর্টের এই নির্দেশ মেনে ভোটে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে কোথা থেকে পুলিশ আনা হবে, তা জানাতে পারেনি রাজ্য। বৈঠকে মীরাদেবী রাজ্য প্রশাসনের প্রতিনিধিদের প্রশ্ন করেন, “আপনাদের দেওয়া হিসেবেই দেখছি ৬৯ শতাংশ বুথই অতি-স্পশর্কাতর কিংবা স্পর্শকাতর। সব মিলিয়ে ১ লক্ষ ৯৬ হাজার নিরাপত্তা কর্মী প্রয়োজন। প্রথম দফাতেই ১ লক্ষ ২০ হাজার নিরাপত্তা কর্মী লাগবে। অথচ আপনাদের হাতে রয়েছে মাত্র ৪৫ হাজার। তা হলে কী ভাবে ভোট হবে?” তিনি আরও বলেন, “আমি সরকারকে চিঠি লিখে জানতে চাইব, রাজ্যের সূচি মেনে ভোট করতে হলে যে বাহিনী দরকার, তার সংস্থান কী ভাবে হবে? সরকার জবাব দেওয়ার পরই বিজ্ঞপ্তি জারি হবে।” নির্বাচন কমিশনার রাজ্যকে এ-ও বলেন, “ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে পুরো ভোট প্রক্রিয়ার উপর কমিশনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হওয়া প্রয়োজন। সে জন্য পঞ্চায়েত আইনের ১৩৭ নম্বর ধারায় কমিশনকে (প্লেনারি পাওয়ার) ক্ষমতা দেওয়া আছে। রাজ্যকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে তা ঘোষণা করতে হবে।” সরকার অবশ্য এমন কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি না-ও করতে পারে। কারণ, সে ক্ষেত্রে ভোট প্রক্রিয়া চলাকালীন কনস্টেবল থেকে ডিজি, কেরানি থেকে মুখ্যসচিব সকলেই কমিশনের অধীনে চলে আসবে। ফলে মীরাদেবী চাইলেও সরকার এই পথে হাঁটতে রাজি নয় বলেই জানা গিয়েছে।
তবে এত নিরাপত্তা বাহিনী জোগাড় করা নিয়ে রাজ্য যে দিশাহারা, তা অস্বীকার করছেন না মহাকরণের কর্তারা। এক কর্তার কথায়, “জানি না, কমিশনকে কী জবাব দেব? অতিরিক্ত ৭৫ হাজার পুলিশ কোথা থেকে নিয়ে আসব, তা-ও জানা নেই। মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় বাহিনী আনবেন না। আবার ভিন রাজ্য থেকে এত পুলিশ পাওয়া যাবে না। তা হলে উপায় কী!”
রাজ্যের প্রতিনিধিরা অবশ্য কমিশনকে জানিয়েছিলেন, ভিলেজ পুলিশ, সিভিক পুলিশ, হোম গার্ড এবং অস্থায়ী হোমগার্ড দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো হোক। কিন্তু পত্রপাঠ তা নাকচ করে দিয়েছেন মীরাদেবী। জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশে ভোট হচ্ছে। সুতরাং পুলিশ বা আধা সেনাই দিতে হবে। হোমগার্ড বা অন্য কিছু চলবে না। সেই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, মনোনয়ন-পর্ব থেকেই টহলদারি শুরু করতে হবে। সে জন্য ৩০ হাজার ফোর্স দরকার। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও রাজ্যকে করতে হবে। এর পরেও প্রচার পর্বে প্রায় ৩ লক্ষ প্রার্থীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ডিএম-এসপিরা যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, তাতে মনোনয়ন পেশ শুরু হলেই ব্যাপক গোলমাল আরম্ভ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে হেতু আদালতের হস্তক্ষেপে ভোট হচ্ছে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে সামান্য শিথিলতাও দেখানো হবে না, জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার।
এই জটিলতা কী ভাবে কাটবে, প্রশ্ন করা হলে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমার দফতরের কাজ ছিল বিজ্ঞপ্তি জারি করা। তা করে দিয়েছি। এখন বাকি যা কিছু, তা
স্বরাষ্ট্র দফতর আর কমিশন ঠিক করবে। পঞ্চায়েত দফতরের কাজ আবার শুরু হবে নতুন গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন হওয়ার পরে।”
এ দিন রাজ্য সরকারের তরফে যে রিপোর্ট কমিশনে পেশ করা হয়েছে, তাতেই বলা হয়েছে, তিন দফায় ভোট হবে ৫৭ হাজার ৯৭৭টি বুথে (বা ৪৩ হাজার ভোট গ্রহণ কেন্দ্র)। তার মধ্যে ৪০ হাজার ১৩৮টি বুথই হল অতি-স্পর্শকাতর অথবা স্পর্শকাতর। যা মোট বুথের প্রায় ৬৯ শতাংশ। সরকারের হিসেব অনুযায়ী প্রথম দফাতেই ভোট হওয়ার কথা ৩৬ হাজার ২২৮টি বুথ বা প্রায় ২৯ হাজার ভোট কেন্দ্রে (দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় এই কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ৭৫০০ ও ৬৫০০)। জেলার ডিএম-এসপিদের রিপোর্টই বলছে, ৪৩ হাজার ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের মধ্যে গোলমালের আশঙ্কা নেই, এমন বুথের সংখ্যা মাত্র ৭৫৯০।
ওই রিপোর্টে সরকারই কমিশনকে জানিয়েছে, সব মিলিয়ে ১ লক্ষ ৯৬ হাজার পুলিশ কর্মী প্রয়োজন। তার মধ্যে ১ লক্ষ ৪১ হাজার সশস্ত্র পুলিশ, ১২০০ জন গ্যাসধারী এবং ৫৪ হাজার লাঠিধারী পুলিশ জোগাড় করতে হবে। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক কাজ করার জন্য চাই সাড়ে ১৮ হাজার এনভিএফ। বুথের স্পর্শকাতরতা বিচার করে খাতায়-কলমে যে পুলিশি ব্যবস্থার কথা কমিশনকে জানানো হয়েছে, তা বাস্তবে জোগাড় করা যে এক প্রকার অসম্ভব, সে কথা মেনে নিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারাও। তাঁদের বক্তব্য, নিরাপত্তা বাহিনী জোগাড় করাই এখন সব থেকে বড় গেরো। কারণ, সরকার আধা সেনা চাইবে না। আবার ভিন্ রাজ্য থেকে এত পুলিশও পাওয়া যাবে না।
অতঃকিম?
জবাব নেই মহাকরণের কর্তাদের। |