|
|
|
|
গুরুত্ব সীমান্ত-নদী-বাণিজ্যে |
তিক্ততা কাটিয়ে বন্ধুত্ব, হাত ধরল দিল্লি-বেজিং |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
ঘাড়ের কাছে ড্রাগনের নিঃশ্বাস থেকেই যাবে। তার মধ্যেও অনুপ্রবেশ-কাণ্ডের ফলে তৈরি দ্বিপাক্ষিক তিক্ততা অনেকটাই দূরে সরিয়ে চিনের নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে নয়া পথনির্দেশিকা তৈরি করতে সক্ষম হল নয়াদিল্লি।
দীর্ঘ এক মাসের দমচাপা উত্তেজনার পর আজ দৃশ্যতই খুশির ছবি সাউথ ব্লকে। যে বিষয়গুলি নিয়ে ওয়েন জিয়াবাও-এর সময় থেকে ক্ষোভ জানিয়ে আসছে ভারত, আজকের যৌথ বিবৃতিতে তার বিশদ উল্লেখ এবং সমাধানের রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং আজ হায়দরাবাদ হাউসের সাংবাদিক বৈঠকে একাধিক বার সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখার প্রশ্নে ইতিবাচক সওয়াল করেছেন। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে ‘কৌশলগত বোঝাপড়া’ বাড়ানোর আহ্বানও জানিয়েছেন। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা কমানো থেকে শুরু করে সীমান্ত অশান্তি নিয়ে ভারতের শর্তে (বিশেষ প্রতিনিধি স্তরে) আলোচনার প্রশ্নে একমত হয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। আটটি সমঝোতাপত্রে সই করেছেন দু’দেশের নেতারা। তৈরি হয়েছে দু’দেশের মধ্যে আশু দৌত্যের ক্যালেন্ডারও। বেজিং-এ নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জয়শঙ্করের কথায়, “প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং-এর ব্যক্তিগত রসায়নই আজকের শীর্ষ বৈঠককে ফলপ্রসূ করে তুলল।” |
|
চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং-এর সঙ্গে মনমোহন সিংহ। সোমবার নয়াদিল্লিতে। |
এটা ঘটনা যে কুড়ি দিন ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনা সেনা কেন ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকল, তার সদুত্তর লি দেননি। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না-ঘটে, সেই মর্মে কোনও চুক্তিপত্রও সই হয়নি। দু’দেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া নদীগুলির জল নিয়ে তথ্য বিনিময় বাড়ানোর বিষয়ে চুক্তিপত্র সই হলেও কোনও নতুন মেকানিজম তৈরির কথা বলেনি চিন। কিন্তু বিদেশ মন্ত্রক মনে করছে, আজ যা পাওয়া গিয়েছে, তা হল, ঝুলে থাকা বিষয়গুলির সমাধানে চিনা নেতৃত্বের সদিচ্ছা।
গত কাল নৈশভোজ বৈঠক থেকে শুরু। আজ গোটা দিন চিনের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ধারাবাহিক দৌত্যে নিজেদের উদ্বেগ এবং অস্বস্তিগুলি বিশদে তুলে ধরেছে নয়াদিল্লি। বৈঠক শেষে চিনা প্রধানমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে ব্রহ্মপুত্র থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক লাদাখ-কাণ্ডের জোরালো উল্লেখ করেছেন মনমোহন। তাৎপর্য পূর্ণ ভাবে, সেই সমস্যাগুলি মেনে নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত আস্থা বাড়ানোর ডাক দিয়েছেন চিনা প্রধানমন্ত্রীও।
গত কালই চিনা প্রধানমন্ত্রীকে মনমোহন জানিয়েছিলেন, সীমান্ত যদি শান্তিপূর্ণ না থাকে তা হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঠিক পথে চলতে পারে না। আজ শীর্ষ প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি, লাদাখে সেনা অনুপ্রবেশ এবং দু’দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলির জল-তথ্য বণ্টন নিয়ে মেকানিজম তৈরির মতো বিষয়গুলিতে অগ্রাধিকার দিয়েছেন ভারতীয় নেতৃত্ব। পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ওয়েস্টার্ন সেক্টরে সাম্প্রতিক ঘটনার থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গিয়েছে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সীমান্তে শান্তি ও স্থিরতা বজায় রাখতে আরও ব্যবস্থা নিতে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” দু’মাস আগে সীমান্ত সমস্যা মেটানোর প্রশ্নে যে নতুন মেকানিজম (বর্ডার ডিফেন্স কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট) চিন দিয়েছিল, কার্যত তার কোনও উল্লেখই করেননি মনমোহন। এ নিয়ে মুখ খোলেননি লি খ্যছিয়াং-ও। বরং বলেছেন, “আমরা অস্বীকার করছি না যে আমাদের তরফে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। দু’দেশেই মনে করে, ভারত-চিন সীমান্ত নিয়ে সমস্যা ইতিহাসপ্রসূত। কিন্তু সেটির সমাধান করার চেষ্টার পাশাপাশি সীমান্তে শান্তি এবং সুস্থিতি বজায় রাখতে হবে।”
সীমান্তের সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশের পাশাপাশি যে বিষয়টিকে সমান অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, তা হল দু’দেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া নদী নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যা। মনমোহনের কথায়, “দু’দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর উপরিভাগে বিভিন্ন কার্যকলাপের কারণে নীচের দিকের স্রোত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ আমি জানিয়েছি প্রধানমন্ত্রী লি-কে। এই সব নদীগুলির উপরিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দু’দেশের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মেকানিজম আরও বিস্তৃত করার প্রস্তাবও দিয়েছি।” দু’দেশ যে আটটি সমঝোতা পত্র আজ সই করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বন্যাকালীন সময়ে ব্রহ্মপুত্র/ইয়ালুজাংবু নদীর জলসম্পদ সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাছে এই চুক্তির গুরুত্ব যথেষ্ট। ব্রহ্মপুত্রের উপর চিনের প্রস্তাবিত বাঁধ তৈরির বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক গত বেশ কিছু বছর ধরে উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে। আজ ভারতের রক্তচাপ কিছুটা কমিয়ে লি বলেছেন, “দু’দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী সম্পর্কিত ভারতীয় উদ্বেগকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। এ ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য নয়াদিল্লির সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টিকে আমরা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছি।” |
|
চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং-এর সঙ্গে সনিয়া গাঁধী। সোমবার নয়াদিল্লিতে। |
এর আগের চিনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও-এর সময় থেকেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রশ্নে ক্রমশই পিছিয়ে পড়েছে ভারত। আজ কোনও রাখঢাক না করেই মনমোহন বলেন, “আমি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা লি-কে জানিয়েছি। রফতানি এবং বিনিয়োগের জন্য চিনের বাজার ভারতের সামনে খুলে দেওয়ার অনুরোধও জানানো হয়েছে।” শুধু মুখে বলা নয়, বিষয়টি ভারত-চিন যৌথ বিবৃতিতেও রাখা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্নে ভারত এবং চিন ঐকমত্য হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ওষুধ শিল্প, ভারতীয় তথ্য ও প্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে চিনা সংস্থাগুলির জোরালো যোগাযোগ, কৃষিপণ্য রফতানির মতো বিষয়গুলি।’
যৌথ বিবৃতিতে আরও একটি এমন বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেবে বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। তা হল অসামরিক পরমাণু সহযোগিতা নিয়ে চিনের তরফে আশ্বাস। এর পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমার-চিন অর্থনৈতিক করিডরের বিষয়টিও ঠাঁই পেয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। এ ব্যাপারে চিন সরকারের তরফে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন লি।
সব মিলিয়ে বহু দিন বাদে এক চিনা প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে স্বস্তির হাওয়া বইছে রাজধানীতে। যার পাল্টা এগোতে রাজি ভারতও। শীঘ্রই চিন সফরে যাবেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি। দু’দেশের মধ্যে সেনা পর্যায়ের সহযোগিতা আরও বাড়াতে তাঁর সফরে কথা হবে দু’দেশের মধ্যে। তার পরেই চিন সফরে যাবেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। লাদাখ-সীমান্তে অনুপ্রবেশ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে আগাগোড়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। ফলে তাঁর সফর ঘিরে প্রত্যাশা বেড়েছে দু’দেশের অন্দরেই। এবং যাচ্ছেন যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া। সমাজতান্ত্রিক চিনে গিয়ে তিনি কী দাওয়াই দেন, এখন সেটাই দেখার।
|
ভারত-চিন সমঝোতা |
• দু’দেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া নদীর জল নিয়ে তথ্য বিনিময়
• ভারতীয়দের কৈলাস-মানস সরোবর যাত্রায় বিশেষ সুবিধা
• মোষের মাংস, মাছ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রফতানি উন্নয়ন
• নিকাশি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে সমঝোতা
• দু’দেশের ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ প্রকল্প
• দু’দেশের বিভিন্ন শহরের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো |
|
ছবি: পিটিআই |
পুরনো খবর: লাদাখে অনুপ্রবেশ নিয়ে চিনকে কড়া বার্তা নয়াদিল্লির |
|
|
|
|
|