|
|
|
|
|
বিধবা-মঙ্গল ১... |
পারানির কড়ি জমাতেও
ভিক্ষেই ভরসা
শঙ্খদীপ দাস • বৃন্দাবন |
|
রাধারানির পায়ে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন ওঁরা। বৃন্দাবনে এখন বিধবাদের সংখ্যা বিশ
হাজারের বেশি।
বারো আনাই বাঙালি। রাধেশ্যামের নামটুকু সম্বল করে যে চরম বঞ্চনার
জীবন কাটাচ্ছেন
ওঁরা, তাই নিয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন। |
ফের সাত ঘণ্টা লেট! হেলতে দুলতে তুফান মেল মথুরা স্টেশন ঢুকল রাত সাড়ে ১১টায়। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে পা রাখার জায়গা নেই। স্টেশনের বাইরেও তাই। কাতারে কাতারে মানুষ অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। বৈশাখী পূর্ণিমায় এমনই ভিড়। ট্রেনে যত জন চড়লেন, তার চেয়ে নামলেন বেশি।
ওই যে, সবিতাও নামলেন। সঙ্গে শান্তি। পলিথিনের ব্যাগে ভরা শাড়ি-জামাকাপড়। শান্তির হাতে ছোট একটা পুঁটলিতে পান-দোক্তার কৌটো ছাড়া আরও কিছু টুকিটাকি। দু’দিন আগে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়েছিলেন কাটোয়া থেকে। সঙ্গে চিঁড়েমুড়ি যা ছিল, আগেই শেষ হয়েছে। টুন্ডলায় ট্রেন থামলে শসা কিনে খেয়েছেন। তার পর থেকে পেটে আর কিছু পড়েনি। জেনারেল কামরায় ঠাসাঠাসি করে আসা। শরীর আর দিচ্ছে না। এ বার একটু গড়াতে পারলে হয়।
কিছু খেতে পারলেও বড় ভাল হত। “তবে কি না রাধারানির পায়ে যখন এসে পড়েছি, কাল কিছু না কিছু তো মিলবেই!” গলায় দু’ঢোক জল ঢালতে ঢালতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শান্তি। বৃন্দাবনে যাওয়ার অটো এখন মিলবে না। তার উপরে এতগুলো মানুষকে টপকে বাইরে বেরোনোও এক ঝক্কি। ফুট ওভারব্রিজের নীচে আর পাঁচটা শরীরের মাঝে কিছুটা মেঝে এখনও চিকচিক করছে। শান্তি ডান হাত দিয়ে সেখানেই চাদর পাততে লাগলেন। বাঁ হাতের ব্যামোটা সারেনি। সদ্য প্লাস্টার কাটার সাদা ছোপ লেগে আছে। মাসখানেক আগে সম্পত্তি লিখিয়ে নিতে গিয়ে রাকেশ হাতখানা মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল। কাটোয়ার বিধানপল্লিতে রাকেশের পান গুমটি। শান্তির সবেধন নীলমণি ওই একটিই ছেলে। সবিতা বৃন্দাবনে আগে থেকেই রয়েছেন। তিনি অবশ্য সধবা। কিন্তু স্বামীর কাজের ক্ষমতা নেই। দেশগাঁয়ে ভিক্ষে করতেও শরম লাগে। ব্রজে সে বালাই নেই। ক’দিনের জন্য গ্রামে গিয়ে এ বার তাই শান্তিকেও নিয়ে এসেছেন। বললেন, “ক’টা দিন না-হয় আমার সঙ্গেই থাকবে। তার পর ঠিক নিজেরটা খুঁজে নিতে পারবে।”
তা হয়তো পারবেন! ননীবালাও পেরেছেন। সবলাকেও দিন তিনেক বেগ পেতে হয়েছে মাত্র। ঠোক্কর খেতে খেতে ঠিক পৌঁছেছেন নন্দের বাড়ির দাওয়ায়। কোশীঘাট থেকে ছটাক দূরে বাড়িটা। কাদা-গোবর প্যাচপ্যাচে গোপীনাথ বাজারের লস্যি-মিঠাইয়ের দোকানের ফাঁক দিয়ে ঢুকে গিয়েছে গলি। একটু এগিয়ে ভূত গলির বাঁক ঘুরলেই নন্দ বামুনের বাড়ি। হাটখোলা সদর দরজা, নীচ থেকে অর্ধেকটা ভাঙা। এক সময় এ বাড়ির রৌনক ছিল। এখন রঙ-পলেস্তারা খসে নড়বড়ে অবস্থা। মেঝের চটা উঠে মাটি বেরিয়ে গিয়েছে। কড়িবড়গার কাঠ দাঁত বার করে ভয় দেখায়। উঠোনের এক দিকে তুলসীমঞ্চ। আর এক কোণে জং পড়ে যাওয়া টিনের দরজা দেওয়া পিছল বাথরুম। দুর্গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার উপক্রম। উল্টো দিকে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। বাড়িটা যেন তিনিই ধরে রেখেছেন! নইলে কবেই হুড়মুড়িয়ে পড়ার কথা ছিল!
দালানের একটা কোণে ননীবালার আস্তানা। আলসেতে কালিঝুলি মাখা কিছু জিনিসপত্র। মেঝেতে ছড়ানো দু’তিনটে বাসন। দড়িতে ভেজা কাপড় ঝুলছে। একটা জনতা স্টোভ। বাকি পরিসরে সাড়ে তিন ফুট লম্বা মানুষেরও পা ছড়িয়ে শোওয়ার জো নেই। বিস্কুটের কার্টুন চ্যাপ্টা করে গদি বানিয়ে তাতেই ননীবালা-সবলাকে শুতে হয়। সেখানে গিয়ে বহিরাগত কেউ দাঁড়ালে ননীবালা ইতস্তত করেন। লজ্জা পান। সিলিংয়ের কালিঝুল দেখিয়ে বলেন, “গেল বছর পা ভেঙেছিল। তার পর থেকে আর মোছামুছি করতে পারি না।” মাস গেলে দুশো টাকা গুনে নেন ‘ম্যানজারবাবু’। ভিক্ষে করে কোনও মাসে টাকা দিতে পারেন। কোনও মাসে বাকি পড়ে যায়।
দেশগাঁয়ে ভরা সংসার ছিল ননীবালার। হাবড়ায় জমিজমা নিয়ে পরিবার। কিন্তু সে আর সইল কোথায়! ছেলে পল্টুর বউটা অকালে মারা গেল। মা-মরা নাতিটাও টিকল না। পড়শির অপবাদে আমগাছ থেকে ঝুলে পড়ল পল্টু! ননীবালার আর সংসারে মায়া নেই! তবে সবলার আক্ষেপ ননীবালার থেকেও এক কাঠি বেশি। সংসারেরই মায়া নেই তাঁর উপর। পাঁচ কাঠা জমির উপর তাঁরও বাড়ি আছে হাবড়ার শ্রীনগর গ্রামে। স্বামী জানকী পাল মাটির হাঁড়ি-কলসি বানিয়ে হাটে বেচতেন। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় দেহ রাখেন। তারপর দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে আর ছেলেকে মানুষ করে শরীরে আর বল নেই সবলার। “কিন্তু সে খোঁজ ঘরের লোকই রাখে না! ছেলে কার্তিক কাজে বেরোলেই বউমা মারধর করে। খেতে দেয় না।” আর ছেলে? সবলার বুকের জ্বালা দলা পাকিয়ে ওঠে। মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, “গর্ভে কালসাপ ধরেছিলাম! বে-শাদি করতেই ছেলের মাথা বিগড়ে গেল!” অমন সংসারে পড়ে থাকার চেয়ে রাধারানির পায়ে পড়ে থাকা সবলার কাছে ঢের ভাল!
নন্দের বাড়ির পিছনে এক চিলতে উঠোন। সেখানে জংলা গাছের মাঝে কিছু নটেশাক উঠেছে। ভিক্ষের চাল আর শাক সেদ্ধ দিয়েই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। তবু চাল জুটেছে তাই। নইলে কোনও মন্দিরের বাইরেই হত্যে দিতে হত। এত দিনে অবশ্য গা সওয়া হয়ে গিয়েছে ননীবালার। বলেন, “এই মরা পেট চালাতে আর কী লাগে বাবা!’’ বরং ভিক্ষের টাকা রোজ একটু একটু করে বাঁচান ননী। কৌটোয় ভরে লুকিয়ে রাখেন নন্দের বাড়ির আলসেতে। তার হদিস সবলা ছাড়া কাকপক্ষীতেও জানে না। লম্বা শ্বাস ছেড়ে দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে পড়েন ননীবালা। সবলাও কুঁজো হয়ে গিয়েছেন। বেশি ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাজায় ব্যথা হয়। ন্যাতা হয়ে যাওয়া সাদা থানের খুঁট দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে অজান্তেই মুছে যায় কপালের রসকলি। ননীবালা বলেন, “কে আগে যাব, তা রাধারানিই জানেন। তবে কি না এখন গেলেই হয়!” তা হলে টাকা জমিয়ে আর কী হবে গো? ভাবান্তর হয় না বৃদ্ধার। বলেন, “ওটা পারানির কড়ি বাছা। মরলে মুখে আগুন দেবার টাকা। নইলে কে বলতে পারে রাতবিরেতে হাত-পা মুড়ে বস্তায় পুরে লাশ ফেলে আসবে যমুনায়।”
ব্রজভূমে এমন মরণোত্তর প্রাপ্তি ইদানীং আখছার হয়। সরকার বাহাদুরও জানে সে কথা। এঁদো আবর্জনায় পা জড়িয়ে চড়া পড়েছে যমুনায়। জল নিমিত্ত। সে জলে শরীর ভাসিয়ে দিলেও কি কম পুণ্যি! তবে কি না হিন্দুর ঘরের মেয়ে তো, ছেলের হাতে না জুটুক, ননীবালা চান মৃত্যুর পর তাঁর মুখে অন্তত আগুনটা পড়ুক। চোখে তুলসীপাতা। বলেন, “এ বেন্দাবনের মাটি চন্দন গো! ছাই হয়ে মিশে গেলে সেই তো বৈকুন্ঠবাস!”
বৃন্দাবনে ননীবালা-সবলার মতো বিধবার সংখ্যা এত দিনে বিশ হাজার ছাড়িয়েছে। মথুরার টিকিট কালেক্টর পবন কুমার জানালেন, “রোজ দু’পাঁচজন করে আসতেই থাকেন। যাঁদের মধ্যে বারো আনার বেশি বাঙালি বিধবা।” হাঁড়ির চালের
মতো এক জনের সঙ্গে কথা বললেই ঠাওর করা যায় বাকিদের যন্ত্রণার বারোমাস্যাও।
|
(চলবে) ছবি: ইয়াসির ইকবাল |
|
|
|
|
|