আরও এক মাস অপেক্ষা করব, বললেন শিল্পমন্ত্রী |
সরকার বদলাচ্ছে, মন্ত্রী বদলাচ্ছে। কিন্তু দুর্গাপুরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশনের (এমএএমসি) কারখানা খুলছে না।
ইতিমধ্যে রুগ্ণ কারখানাটি একযোগে কিনে নিয়েছে তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। কিন্তু জমির রেজিস্ট্রেশন করা নিয়ে তাদের মধ্যেও শরিকি কাজিয়া চলছে। কারখানা নিলাম হওয়ার সময়ে যাঁরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, আড়াই বছর কেটে যাওয়ায় সেই শ্রমিক-কর্মীরাই ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছেন। সোমবার দুর্গাপুরে এসে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অনন্তকাল তো বসে থাকা যায় না! আরও এক মাস অপেক্ষা করব। এর পর তিন সংস্থাকে ডেকে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবতে হবে আমাদের।” |
বন্ধই পড়ে কারখানা।—ফাইল চিত্র। |
মূলত খনিতে ব্যবহারের যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ভারী শিল্প মন্ত্রকের অধীনে কারাখানাটি চালু হয়েছিল। এক সময়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। পরে বিভিন্ন কারণে কারখানা রুগ্ণ হয়ে পড়ে এবং ২০০১ সালের ৫ অক্টোবর পাকাপাকি বন্ধ যায়। প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মীকে স্বেচ্ছাবসর দেওয়া হয়। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৫ সালে হাইকোর্ট লিক্যুইডেটর নিয়োগ করে।
এর পরেই ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে। ২০০৭ সালের ১ জুন তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেড (বিইএমএল), কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড (সিআইএল) এবং দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) মৌ চুক্তি স্বাক্ষর করে যৌথ ভাবে (একে বলে কনসোর্টিয়াম) কারখানা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, বিইএমএল ৪৮ শতাংশের অংশীদার, বাকি দুই সংস্থার ভাগে পড়েছে ২৬ শতাংশ করে। ২০১০ সালের ১১ জুন হাইকোর্টে নিলামে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি টাকা দর দিয়ে এমএএমসি-র দায়িত্ব পায় তারা। নতুন নাম হয় এমএএমসি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
ওই বছরেরই ১০ অক্টোবর দুর্গাপুরে বিএসিউপি প্রকল্পে নির্মিত আবাসনের উদ্বোধন করতে এসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। কিছুই হয়নি। পরের বছর মে মাসে সরকার পাল্টে যায়। গত ৩১ জানুয়ারি নতুন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, সে দিনই বিইএমএলের চেয়ারম্যানকে মহাকরণে দ্রুত কারখানা খোলার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। তার পরেও দশ মাস পেরিয়ে গিয়েছে।
এমএএমসি-র নতুন নাম হয়েছে এমএএমসি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কনসোর্টিয়াম সূত্রের খবর, তিন সংস্থার জোট বাঁধার মূল ভিত্তি পরস্পরের উপরে নির্ভরতা। চুক্তি অনুযায়ী, নতুন কারখানায় খনির যন্ত্রপাতি তৈরি করবে বিইএমএল। কোল ইন্ডিয়া তা কিনে নিজেদের কয়লা খনিতে ব্যবহার করবে। যে কয়লা উঠবে তা ব্যবহার করবে ডিভিসি। আপাতত বাইরের বরাতের ভরসায় বসে থাকছে না কনসোর্টিয়াম। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতায় নামার মতো পরিস্থিতি নতুন সংস্থার থাকবে বলে বলে মনে করছেন না তিন সংস্থার কেউই। সবই ঠিক হয়ে গিয়েছে।
তবু সমস্যা কোথায়?
কনসোর্টিয়াম সূত্রে জানা গিয়েছে, কারখানার ১৯৩ একর জমি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে শুধুমাত্র বিইএমএলের নামে। বাকি দুই সংস্থার কর্তৃপক্ষের কাছে যা রীতিমতো সমস্যার। এমন পরিস্থিতিতে তাদের থাকতে হবে বিইএমএলের অধীনে। কিন্তু তা তাঁরা কেন মানবেন? যেখানে কনসোর্টিয়ামে তাঁদেরও যৌথ অংশীদারিত্ব বিইএমএলের থেকে ৪ শতাংশ বেশি। সিআইএলের চিফ জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে বছরখানেক আগে অবসর নিয়েছেন অচিন্ত্য কুমার সুরাল। তিনি বলেন, “কনসোর্টিয়াম দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সিআইএল কারখানা খোলার জন্য লড়ে যাচ্ছে। অথচ ২০১০ সালের ২৫ অগস্ট বিইএমএল কিছু না জানিয়ে নিজেদের নামে কারখানার রেজিস্ট্রেশন করে নেয়। কেন সিআইএল তা মেনে নেবে?”
সেই সমস্যা অবশ্য মেটানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের শেষ দিকে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ডিভিসি ও সিআইএল নিজের নিজের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স মিটিংয়ে শেয়ার হোল্ডিং চুক্তি চূড়ান্ত করে। ডিভিসি’র তৎকালীন সিনিয়র সচিব, বর্তমানে ডিভিসির মাইথন প্রজেক্টের জিএম এমআই গনি এবং সিআইএলের জিএম (নিউ ইনিসিয়েটিভ) প্রবীর কুমার সাহা জানিয়েছেন, শেয়ার হোল্ডিং চুক্তির খসড়া তাঁরা বিআইএমএলের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছেন। বিইএমএল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৬ অক্টোবর তারা পুরো বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে (যেহেতু বিইএমএল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীন সংস্থা)। বিইএমএলের জিএম অতনুরতন ভট্টাচার্য সোমবার বলেন, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছি।”
কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ছাড়পত্র মিলবে কবে?
আইএনটিইউসি’র সর্বভারতীয় সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ জি সঞ্জীব রেড্ডি এবং দুর্গাপুরের বিধায়ক অপূর্ব মুখোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির কাছে দ্রুত সুরাহা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। সিটু নেতা বিনয়েন্দ্রকিশোর চক্রবর্তীর অভিযোগ, “কেন্দ্র বা রাজ্য, কারও স্পষ্ট উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।” এআইটিইউসি-র শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক স্বপন বিশ্বাসের মতে, “কনসোর্টিয়ামের তিন সংস্থার মধ্যেই আসলে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।”
কারখানার যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন সব মহলই। গত বছর ৩০ মে কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফ কারখানা থেকে সরে যায়। তার পরেই বহু দামি যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলেছে লোহাচোরেরা। শেষে বেসরকারি এক নিরাপত্তা সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে কনসোর্টিয়াম। তবে এর পরেও শ্রমিক সংগঠনগুলি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
কনসোর্টিয়াম সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ছাড়পত্র মেলার পরেই এমএএমসি নিয়ে তিন সংস্থার শেয়ার হোল্ডিং এগ্রিমেন্ট চূড়ান্ত হবে। জমির পুরনো রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে কারখানার ১৯৩ একর জমি তিন সংস্থার নামে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করা হবে। শুরু হয়ে যাবে কারখানা খোলার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া। শিল্পমন্ত্রী বলেন, “তিন সংস্থা যা যা চেয়েছে, রাজ্য সরকারের তরফএ সব ধরনের সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু এ বার ওদের সময় নির্দিষ্ট করে এগোতে হবে। কারখানা খোলার ব্যাপারে আমরা এখনও আশাবাদী।”
|