|
|
|
|
মমতার মুখ থমথমে, কমিশনে খুশির হাওয়া |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মহাকরণ থেকে বেরনোর কথা ছিল ঠিক সাড়ে ৩টেয়। কিন্তু টুকিটাকি কাজ সারতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তত ক্ষণে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের রায় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। খবর পৌঁছে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কানেও। মহাকরণ থেকে যখন বেরোচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ থমথম করছে। সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। গটগট করে নেমে উঠে পড়লেন গাড়িতে। ঘড়িতে তখন ৪টে বেজে ১০।
এর ঠিক ১০ মিনিট আগেই বাঁকুড়া-পুরুলিয়া সফরের জন্য মহাকরণ থেকে বেরিয়েছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। হাইকোর্টের রায় শুনতে গিয়েই দেরি হয়েছে তাঁরও। পঞ্চায়েতসচিব সৌরভ দাস যত বার তাঁকে বেরোনোর জন্য তাগাদা দিচ্ছেন, সুব্রতবাবু বলছেন, “দাঁড়াও, রায়টা দেখেই যাই।” মহাকরণের লিফ্টে ধরা গেল তাঁকে। বললেন, “হাইকোর্ট কী বলেছে, তা তো পুরোটা জানি না। রায় আমাদের পছন্দ না হলে অবশ্যই ডিভিশন বেঞ্চে যাব।” |
প্রসঙ্গ: পঞ্চায়েত রায় |
কমিশনের দাবি |
সরকারের যুক্তি |
তিন দফায় ভোট |
ভোটের দিন ঘোষণার দায়িত্ব রাজ্যের |
দিন ঘোষণার আগে তাদের সঙ্গে
কার্যকরী আলোচনা করুক রাজ্য |
জেলাবিন্যাসও
বলবে তারা |
বুথ পিছু দু’জন
সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী |
প্রতি ভোট কেন্দ্রে (যেখানে একাধিক
বুথ থাকে) দু’জন সশস্ত্র পুলিশ |
এর জন্য চাই ৮০০
কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী |
যথেষ্ট সশস্ত্র পুলিশ আছে,
কেন্দ্রীয় বাহিনী লাগবে না |
|
একটু পরেই সুব্রতবাবুকে কিন্তু মহাকরণেই ফিরতে হল। মহাকরণের খবর, মুখ্যমন্ত্রীই রায় শোনার পরে সুব্রতবাবুকে ফিরে আসতে বলেন। তত ক্ষণে সুব্রতর ঘরের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার আগে আধ ঘণ্টার বেশি বৈঠক করলেন দু’জনে। তার পরে সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিলেন “আমরা ডিভিশন বেঞ্চে যাচ্ছি।” ঘনিষ্ঠমহলে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। বলেছিলেন, হাইকোর্টের রায়ে সরকার অসন্তুষ্ট। তিনি বিষয়টা এখনই ছেড়ে দেবেন না।
ছবিটা ঠিক উল্টো রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অফিসে। আদালত কমিশনের প্রায় প্রতিটি দাবিকে মর্যাদা দিয়েছে, এ কথা শোনার পরে সেখানে খুশির হাওয়া। দৃশ্যতই খুশি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডেও। বললেন, “সবাই তাকিয়ে ছিল রায়ের দিকে। আমরা খুশি। আশা করি, সময় মতো পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে পারব।” কিন্তু রাজ্য যে বলছে, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চতর আদালতে যাবে? প্রশ্নটা শুনলেন, কিন্তু কোনও উত্তর দিলেন না মীরাদেবী।
রায় শুনতে এ দিন অনেক আগে থেকেই কমিশনের কর্মীরা অফিসে চলে এসেছিলেন। পৌঁছে গিয়েছিলেন কমিশনের সচিব, উপসচিবও। বেলা সওয়া ১১টায় আসেন মীরা। ১২টা নাগাদ কমিশনের গাড়িতে চেপে হাইকোর্টে রওনা দেন মামলার তদারকি অফিসারেরা। বাকি কর্মীদের চোখ তখন থেকেই টিভির দিকে।
৩টে নাগাদ রায় ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। তার কিছুক্ষণ আগেই অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়, জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় কোর্টে ঢুকে যান। প্রায় একই সময়ে আসেন কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল এবং তাঁর সহকারী আইনজীবীরা। ২৩ নম্বর কোর্টে এ দিন পা ফেলার জায়গা ছিল না। ভিড়ের ঠেলায় এক সময় কোর্টের দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।
বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার রায় ঘোষণার আগে বলে দিলেন, “টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ নট দ্য কোয়েশ্চেন। পঞ্চায়েত ইলেকশন মাস্ট বি হেল্ড ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল...।” উত্তেজনার পারদ তখন সর্বোচ্চ বিন্দুতে। রায় ঘোষণা হল। হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন সমরাদিত্যবাবু। তাঁকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য বাইরে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন আইনজীবীরা। সমরাদিত্যবাবু আনন্দবাজারকে বললেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে সব সময় শাসক দলের পরিবর্তন ঘটে। এটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু যদি নিরপেক্ষ অবাধ নির্বাচন করা না-যায়, গণতন্ত্রের পক্ষে তা ক্ষতিকারক। সে দিক থেকে এ দিনের রায় একটি ‘মাইলস্টোন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি ।
হাইকোর্ট চত্বরে তখন একটাই জল্পনা, রাজ্য ডিভিশন বেঞ্চে যাবে কি না। সরকারি কৌঁসুলি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “আমি সরকার নই। সরকারের হয়ে মামলা লড়ি। সরকার উচ্চ আদালতে আপিল করবে কি না, তা আমার জানা নেই। অ্যাডভোকেট জেনারেল রায়ের কথা আইনমন্ত্রী ও পঞ্চায়েতমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।” প্রশ্ন উঠল, এই রায়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নষ্ট হল কি? অশোকবাবুর উত্তর, “আমি তা মনে করি না। কারণ মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই পঞ্চায়েত ভোট চেয়ে এসেছেন। কমিশনই হাইকোর্টে এসে মামলা করেছে রাজ্যের বিরুদ্ধে। এতে আমরা কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম।”
পরে কমিশনের পক্ষে অন্যতম আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি বাইরে এসে জানালেন রায়ে বলা হয়েছে, রাজ্যকে আগামী কালের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী এবং পর্যবেক্ষক সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানাতে হবে। তা জানার পরই কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন, কবে কোন জেলায় ভোট হবে তা ঠিক করে রাজ্যকে জানাবে।
একটু পরেই অবশ্য পঞ্চায়েত মন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর বিবৃতি এল। পরিষ্কার হয়ে গেল, জল আসলে আরও অনেক দূর গড়াবে।
|
|
|
|
|
|