রাজ্য নির্বাচন কমিশন ১। রাজ্য সরকার ০। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে প্রথম পর্বের লড়াই শেষে এটাই ফল।
শুক্রবার পঞ্চায়েত মামলায় অন্তর্বর্তী রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার তাঁর এই রায়ে সব দিক থেকে কমিশনের আর্জি মেনে নিয়েছেন। যে চারটি বিচার্য বিষয় ছিল (নিরাপত্তা বাহিনী, পর্যবেক্ষক, অর্থের ব্যবস্থা ও জেলা বিন্যাস), তার সব ক’টিতেই কমিশনকে এগিয়ে রাখা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, আজ, শনিবারের মধ্যে রাজ্যকে পর্যবেক্ষকের সংখ্যা জানাতে হবে। একই ভাবে কমিশনের
চাহিদামতো নিরাপত্তা বাহিনীরও ব্যবস্থা করতে হবে। কত কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যবস্থা করবে সরকার, তা-ও তাদের শনিবারের মধ্যেই জানাতে হবে। এই দুই বিষয়ে রাজ্যের কাছ থেকে তথ্য পেলে তবেই ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করবে কমিশন। তারা সেই দিনের কথা চিঠি দিয়ে জানাবে রাজ্যকে। কমিশনের সেই চিঠি পেলে তবেই ভোটের দিন ঘোষণা করবে রাজ্য।
রাজ্য সরকারের সব দাবিই নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে এ দিনের রায়ে। তাদের বক্তব্য ছিল, ভোটের দিন ঘোষণার দায়িত্ব তাদের। সেইমতো জেলাবিন্যাসও তারাই করে দেবে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রশ্নে অর্থ সঙ্কটের যুক্তি দিয়েছিল রাজ্য। আরও বলেছিল, রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে ভোট করানো সম্ভব। প্রয়োজনে ভিন রাজ্যের পুলিশও আনা যেতে পারে।
এ দিনের রায় থেকে স্পষ্ট, এর কোনওটিই মানেননি বিচারপতি।
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে তিন দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। অবাধ নির্বাচনের জন্য কমিশনকে কেন্দ্রীয় বাহিনী-সহ অন্য সব পরিকাঠামোগত সাহায্য দেবে রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশনই নির্বাচনের দিন ঠিক করবে। কোন জেলায় কবে ভোট
হবে সেটাও ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন। রাজ্য সরকার শুধু ভোটের দিন ঘোষণা করবে।
রাজ্য যে সাংবিধানিক সঙ্কট এড়াতে ১০ জুনের মধ্যে ভোট করানোর কথা বলছিল, তার উল্লেখ করে বিচারপতি এখনই উদ্যোগী হতে বলেছেন রাজ্যকে। আজ, শনিবারের মধ্যে পর্যবেক্ষক ও কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে তথ্য জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হাইকোর্ট চায়, সাংবিধানিক সঙ্কট এড়াতে জুনের মধ্যেই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হোক।
এই অবস্থায় রাজ্য কী করবে? রায় জানার পরে প্রতিক্রিয়ায় পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যা বলেছেন, তার থেকে স্পষ্ট, সরকার এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। সুব্রতবাবুর বক্তব্য, হাইকোর্টের নির্দেশ অবাস্তব। আরও জানিয়েছেন, সোমবারেই রাজ্য ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করবে। হাইকোর্টের রায়কে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর উপরে আঘাত বলে ঘনিষ্ঠমহলে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও জানিয়েছেন, তিনি লড়াই ছাড়বেন না। কোনও ভাবেই এই রায় মানবে না রাজ্য সরকার।
এই মন্তব্য থেকে অনেকে মনে করছেন, ডিভিশন বেঞ্চে হেরে গেলে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যাবে। আর ডিভিশন বেঞ্চ যদি বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের এ দিনের রায় খারিজ করে দেয়? তা হলে কমিশনও যে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে, সেই ইঙ্গিতও মিলেছে কমিশন সূত্রে। অর্থাৎ, পঞ্চায়েত মামলা নিয়ে জল এখনও বহু দূর গড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে জুন মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট হবে কি না, তাই নিয়ে সংশয়ে পঞ্চায়েত দফতর। জুনেই শেষ হচ্ছে পঞ্চায়েতগুলির মেয়াদ। তার পরে সেগুলি কী ভাবে চলবে, সে ব্যাপারে রাজ্য সরকারের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে দফতর।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য সরকার যদি এই রায়কে সোমবার চ্যালেঞ্জ জানানোই মনস্থ করে ফেলে, তা হলে কি তারা আজ, শনিবার
রায়ের নির্দেশমতো কমিশনকে তথ্য পাঠাবে? প্রশাসন সূত্রের খবর, রায়কে যদি চ্যালেঞ্জই জানানো হয়, তা হলে তা মানার প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে? ঘটনা হল, সে ক্ষেত্রে রাজ্য আদালত অবমাননার দায়ে পড়বে। তা নিয়ে অবশ্য এখন কিছু ভাবছে না রাজ্য।
নির্বাচন কমিশনের স্বাভাবিক ভাবেই খুশির ছবি। কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, তারা রায়ে খুশি। রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি সমাদ্দার প্রতিটি পর্যায়ে যে ভাবে নির্বাচন কমিশনের দাবির যর্থাথতা বর্ণনা করেছেন, তাতে ডিভিশন বেঞ্চেও ফল তাদের পক্ষেই যাবে বলে কমিশন সূত্রে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
এ দিন রায়ে কী বলেছেন বিচারপতি সমাদ্দার? বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলারক্ষার ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণ, এ সবই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত। এখানে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের কোনও অবকাশ নেই। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্থা। বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, “আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ার ঠিকই। কিন্তু ভোটের সময় তা রাজ্য সরকারের হাতে ছাড়া যায় না। মনে রাখতে হবে, সরকার পরিচালনা করে রাজনৈতিক দল। সব রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য থাকে ভোটে জেতা। নির্বাচন যদি রাজ্য সরকার পরিচালনা করে, তা হলে তা নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন।” আর সে জন্যই কোন বাহিনী কত সংখ্যায় ব্যবহার করবে, সেটা গোটাটাই কমিশনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত বলে জানিয়ে দেন তিনি।
হাইকোর্ট আরও জানিয়েছে, পর্যবেক্ষকও কমিশনই ঠিক করবে। কমিশন রাজ্য সরকারের কাছে চারশো পর্যবেক্ষকের নাম চেয়েছিল। রাজ্য সরকার ২৬০ জনের নাম দেয়। এ দিন রায়ে বলা হয়েছে, আজ শনিবারেই রাজ্য সরকারকে বাকি পর্যবেক্ষকদের নাম কমিশনের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে অর্থ সঙ্কটের যুক্তিও দিয়েছিল রাজ্য সরকার। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় প্রথমে জানান, ভোটের টাকা দিতে অসুবিধা হবে না। পরে বলেন, রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট চলছে। এই অবস্থায় ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে হলে বিশাল টাকা খরচ হবে। নির্বাচনের জন্য রাজ্য সরকার কমিশনকে এ পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকা দিয়েছে। বলা হয়েছিল, ২০৯ কোটি টাকা দেওয়া হবে। বিচারপতি এই বিষয়ে বলেন, গণতন্ত্রের মূল বিষয় হল, সকলে যাতে নির্ভয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। আর্থিক সঙ্কটের জন্য এই গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে আপস করা যায় না।
এর পরেই বলা হয়, ক’দফায় ভোট হবে, জেলা বিন্যাস কী হবে, সব ঠিক করবে কমিশন। কমিশন ভোট পরিচালনা করবে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন থেকে ফল ঘোষণার পর বেশ কিছু দিন পর্যন্ত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা তাদের দায়িত্বে থাকবে। দেশের ভোট করতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দিয়েছে সংবিধান, একই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে রাজ্য কমিশনকেও। গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে তাই তারাই পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনার শেষ কথা বলবে।
|