মুখোমুখি ...
মৃত্যুর পর উঁকি মেরে যদি দেখতে পেতাম
কে কী বলছে টলছে

ত্রিকা: ইংরেজি আত্মজীবনীতে ছবির ক্যাপশনে দেখলাম নিজেই লিখেছেন, হায় রে জীবনটা যদি ড্রেস রিহার্সাল হত। যদি আবার নতুন করে শুরু করার সুযোগ পেতাম!
মৃণাল: হ্যঁা, লিখেছি তো!

পত্রিকা: কী ছবি বানাতেন নতুন করে শুরু করলে?
মৃণাল: খালি মনে হয় নিজের ছবির বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে জড়ো করে যদি ছবি করতে পারতাম যে তারা তখন কেমন ছিল। আর এখন কেমন আছে!

ত্রিকা: নতুন সুযোগ পেলে ‘পথের পাঁচালী’ বানাতেন না?
মৃণাল: (খানিক ক্ষণ স্তব্ধ) না। করতাম না।

পত্রিকা: কেন?
মৃণাল: হয়ে গেছে যেটা সেটা আর কেন করব? তা ছাড়া খুবই ভাল ছবি। কমপ্লিট ছবি।

পত্রিকা: তাতে কী? নতুন জন্মে তো ছবির পুরনো মালিকানা থাকত না?
মৃণাল: তাতেও না। ‘পথের পাঁচালী’ সত্যিই কমপ্লিট ফিল্ম। ভাবলে অবাক লাগে ‘পথের পাঁচালী’র বিষয় যদিও গ্রাম, এত নাগরিক মন নিয়ে ছবিটা করা, সেই আর্বান সিভিলিটিটা মুগ্ধ করে। আর কোনও পরিচালক হলে গ্রামের মতো করে করত।

পত্রিকা: সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ ছবি?
মৃণাল: নাহ্। সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ ছবি আমার মতে ‘অপরাজিত’। আজও কী অসম্ভব সমকালীন! ‘অপরাজিত’ এমন একটা ছবি, যা প্রমাণ করে সমকালীনতা মোটেও সেই পিরিয়ডের ওপর নির্ভর করে না। অ্যাটিচিউডের ওপর নির্ভর করে। আহা, আমি যদি এ রকম একটা ফিল্ম বানাতে পারতাম!

পত্রিকা: আর একটা জীবনের সুযোগ পেলে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বানাবেন?
মৃণাল: একেবারেই না।

পত্রিকা: কেন? সেটা করার আবার কী সমস্যা?
মৃণাল: আসলে যে কারণে ছবির খ্যাতি। সুপ্রিয়ার সেই ডায়ালগটা, যখন সে জেনে গিয়েছে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যু অনিবার্য। যখন বলছে, দাদা আমি বাঁচতে চাই। যখন অনিল ওর সঙ্গে দেখা করতে গেল। টেলি ফোটো লেন্সে তখন অনিল আর সুপ্রিয়া দু’জনকেই ধরেছে। ক্যামেরায় দশ অ্যাপারচার দিয়ে প্রখর রৌদ্রে শুটিং হচ্ছে। আকাশটা মনে হচ্ছে নেমে এসেছে। অসাধারণ দৃশ্য। এই সময় অনিল হঠাত্‌ করে নিষ্ঠুর মোটা চামড়ার লোকের মতো বোনের ভরা সংসারের কথা বলতে শুরু করে দিল। বলল, “গীতার ছেলেটার দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কী যে একটা আগ্রহ না! বাবার লাইফটা একেবারে হেল করে ছেড়ে দিয়েছে।” এটা যেন দাদা আমি বাঁচতে চাই কথাটা বলানোর জন্যই বলা। যেটা আমার বরাবরই ভীষণ প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে মেলোড্রামাটিক। ঋত্বিকের মধ্যে এই মেলোড্রামা ব্যাপারটা ছিল।
পত্রিকা: আপনি নিজে করলে জায়গাটা বদলাত?
মৃণাল: অবশ্যই। আমার নাগরিক মন দিয়ে চেঞ্জ করতাম। মানিকবাবু বানালেও অনিবার্য ভাবে তাই হত।

পত্রিকা: আপনি এত মানিকবাবু-মানিকবাবু করছেন। উনি কিন্তু আপনার ফিল্মের বেশ তির্যক সমালোচনাই করেছেন। ‘ভুবন সোম’ সর্বজনপ্রশংসিত ছবি। অথচ সত্যজিত্‌ রায় রিভিউ লিখলেন, ‘Big Bad Bureaucrat Reformed By Rustic Belle’। একটা এত সমাদৃত ছবি সম্পর্কে মনে হয়নি খুব আনচ্যারিটেবল?
মৃণাল: আনচ্যারিটেবল লেগেছিল তো বটেই। তবে প্রত্যুত্তরে সেটা বলিনি। শ্রদ্ধার সঙ্গেই জবাবটা দিয়েছিলাম। এর পর মানিকবাবু একদিন ফোন করলেন। বললেন, এত ভাল ভাবে গুছিয়ে বলেছেন। আমাকে তো আপনি লজ্জায় ফেলে দিলেন। আমি বললাম, আপনার এই রিভিউতে তো লজ্জায় পড়লাম আমি। আর একটা কথা মানিকবাবু বলি, চাইলে আপনাকে কিন্তু কড়া দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে পারতাম! আমি এতটা আক্রমণাত্মক হতে চাইনি। উনি তখন বললেন, একদিন দেখা হলে ভাল হত। আমি তখন সাফ বললাম, আপনার চারপাশে এত স্তাবকের দল আছে যে কাছে যেতে সাহসে কুলোয় না।

পত্রিকা: স্তাবক ছিল বুঝি সত্যজিত্‌ রায়ের?
মৃণাল: ওরে বাবা, প্রচুর।

পত্রিকা: যাক, উনি শেষ পর্যন্ত কী বললেন?
মৃণাল: উনি বললেন আমারও ভীষণ যেতে ইচ্ছে করে আপনার কাছে। যাওয়া হয়ে ওঠে না। লসটা আমার। আমি বললাম লসটা আমারও। অবশ্য আমি তখনও বিরক্ত হয়ে রয়েছি। বললাম, আপনি এত সব স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকেন। নিঃসঙ্গ লাগে না? উনি স্বীকার করলেন, অসম্ভব লাগে। নিজেকে ভীষণ একা লাগে।

পত্রিকা: বলছেন কী? তার পর?
মৃণাল: তার পর আর কী। আমি বললাম, আমি আসব একদিন আপনার কাছে। কিন্তু একটা কথা খেয়াল রাখবেন। আর কেউ যেন না থাকে। শুধু আমি আর আপনি।

পত্রিকা: তার পর গেলেন ওঁর বাড়িতে?
মৃণাল: গেলাম। অনেক কথা হল। উনি আবার নিমাইকে (ঘোষ) সঙ্গে সঙ্গে বলে রেখেছিলেন। ও অতিথিটতিথি এলে বোধহয় এসে ছবি তুলত। আমার আর মানিকবাবুর এই ধরনের ছবি বোধহয় এই একটাই আছে।

পত্রিকা: কখনও মনে হয়েছে সত্যজিত্‌ রায় পর্যায়ের প্রতিভার সমকালীন বড় পরিচালকের কাজ সম্পর্কে আরও দয়ালু হওয়া উচিত ছিল? কোথাও অন্তত পিঠ চাপড়ানির হাত রাখা যেত!
মৃণাল: যত দিন পর্যন্ত জানা আছে এ আমার চেয়ে উপরে উঠবে না, তত ক্ষণ পিঠ চাপড়ানো যায়। যে মুহূর্তে আমি জানি, এ আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তখন আমি আর হাতটা তুলব না। বলে না, বেশি বড় হয়ে গেলে অনেক মুশকিল হয়।

সত্যজিত্‌ রায়, মৃণাল সেন
পত্রিকা: আপনি প্রচুর সব পুরস্কার আর স্বীকৃতি পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্‌সবগুলোর কাছে সমান বরেণ্য। কিন্তু বাঙালি নিজস্ব বিশ্লেষণের সময় কোথাও যেন সত্যজিত্‌কে এক ইঞ্চি হলেও মৃণাল সেন থেকে এগিয়ে রাখে। সেই বিচারে অভিমান হয় না?
মৃণাল: জানি না সে সব। গেঁয়ো যোগী বোধহয় ভিখ পায় না। আর একটা কথাও আছে। সত্যজিত্‌ রায় কিন্তু অসম্ভব গুণী মানুষ। কী কী সব ছবি করেছেন প্রথম দশ বছরের মধ্যে, ভাবা যায় না। আবার ওঁকে নিয়ে নানান মহলের নানা ক্রিটিসিজমও আছে।

পত্রিকা: কোথাও গিয়ে কি মনে হয়নি সত্যজিত্‌ যেন একটা মূর্তির মতো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাঙালি মননে। হোলি কাউ যাকে একটা বাঁকা কথাও বলা যাবে না।
মৃণাল: সেটা মুশকিল। উনি নিজেও তেমন ছিলেন। ওঁকে পালটা প্রশ্ন করতে গেলেই উত্তেজিত হয়ে যেতেন।

পত্রিকা: সত্যজিত্‌-মৃণালের মতোই বাঙালির আরও একটা অন্তহীন তর্ক সৌমিত্র-উত্তম। আপনার ভোট কোন দিকে?

মৃণাল: অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্রকে আমার অনেক বেশি পাওয়ারফুল মনে হয়। উত্তম খেটে উঠেছে। সহজাত অভিনয় দক্ষতা ছিল না ওর।

পত্রিকা: আপনার প্রথম ছবিই তো উত্তমের সঙ্গে।

মৃণাল: হ্যাঁ, ‘রাতভোর’। দ্য মোস্ট ডেভিলিশ ফিল্ম দ্যাট আই এভার মেড। বানাতেই পারিনি।

পত্রিকা: তার পর তো আর কখনও উত্তমের সঙ্গে কাজ করেননি?

মৃণাল: না। একবার উত্তম আর সুপ্রিয়া খুব সকালে ফোন করেছিল। উত্তম সেই ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াক করতে যেত। সে ভাবেই তো পুলিশের সরোজ দত্ত মার্ডারটা ও দেখে ফেলে। একদিন সকালে ফোন করে বলল, আরে আমি তো এই শহরেই থাকি না কি! আপনি একটা ছবি ভাবুন না আমাকে নিয়ে। টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না। ওর অ্যাপ্রোচটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।

পত্রিকা: কিন্তু তার পরেও তো আর কখনও উত্তম কুমারের সঙ্গে আপনি কাজ করেননি?

মৃণাল: হয়ে ওঠেনি। সুযোগ হলে খুব ভাল হত।

পত্রিকা: অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র এগিয়ে কেন, সেটা কিন্তু ব্যাখ্যা করেননি।
মৃণাল: কারণ সৌমিত্রর ইন্টেলেকচুয়াল ডেপ্থটা বেশি। তুলনায় অনেক বেশি শার্প।

পত্রিকা: ভাল অভিনয় সহজাত একটা ব্যাপার। তার সঙ্গে ইন্টেলেকচুয়ালি এগিয়ে থাকার কী সম্পর্ক?

মৃণাল: সম্পর্ক আছে। কে কত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ক্যাচ করতে পারছে, কে কত ভাল বুঝছে, তার ওপর তো অভিনয়ের মান নির্ভর করেই। সৌমিত্র গ্রেট অভিনেতা। যত বয়েস বাড়ছে তত যেন ওর অভিনয়ের ম্যাচিওরিটি বাড়ছে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে
পত্রিকা: সৌমিত্র সম্পর্কে কখনও আপনার বিপরীতমুখী পজেসিভনেস কাজ করেনি?
মৃণাল: কী রকম?

পত্রিকা: যে এই লোকটা আমার প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চোদ্দোটা ছবির নায়ক। ও আর যা-ই হোক কখনও আমার নিজের বলে পরিচিত হবে না।
মৃণাল: (হাসি) আরে না, না। ধুর। আমি হলে তো ‘নায়ক’ ছবিটাও সৌমিত্রকে দিয়ে করাতাম। মানিকবাবু কেন বদলাতে গেছিলেন কে জানে!


পত্রিকা: আপনাদের মতামত আসলে বরাবরই সব ব্যাপারে ভিন্নধর্মী। নইলে বারবার এত সংঘাত হত কেন? শুনেছি লন্ডনে একটা প্রশ্নোত্তর পর্বে আপনার অংশ নেওয়া নিয়েও সত্যজিতের সঙ্গে ঝামেলা বেধেছিল।

মৃণাল: এটা হয়েছিল লন্ডনের ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারে এক সপ্তাহ ধরে আমার ছবির প্রদর্শনী চলার পর ‘গার্ডিয়ান লেকচার’য়ের পর পর। সত্যজিত্‌বাবু হঠাত্‌ কোথা থেকে কী, ‘সানডে অবজার্ভার’ কাগজে মন্তব্য করে বসলেন ‘মৃণাল সেন অলওয়েজ হিটস সেফ টার্গেট।’ আমি পাল্টা মজা করে বললাম, সত্যজিত্‌বাবু সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় আঘাত হেনেছেন। সেটা আমি নিজে। মন্তব্যটা ছিল, ‘হি হ্যাজ হিট দ্য সেফেস্ট টার্গেট, মি’।

পত্রিকা: আপনার আজও ওঁর সম্পর্কে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে বলে মনে হয়।

মৃণাল: দেখুন, ওঁর সঙ্গে আমার নানা সময়ে বিতর্কিত এক্সচেঞ্জ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এটা মানতেই হবে টোটালিটি নিয়ে সত্যজিত্‌ রায়ের ধারে কাছে কেউ নেই। ওঁর পাশে আমি নেহাত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছি।

পত্রিকা: নাসিরকে কোথায় রাখবেন অভিনেতাদের ক্রমপর্যায়ে?

মৃণাল: অবিসংবাদী এক নম্বর। নাসিরের কাছে কেউ লাগে না। মনের ভেতরকারের ইন্টিরিয়র ফ্লেভারটা এমন পর্যায়ের যে কোনও চরিত্র তুলে দেয়। মোস্ট পাওয়ারফুল অ্যাক্টর।

পত্রিকা: আর মিঠুন চক্রবর্তী?

মৃণাল: দুর্দান্ত অভিনেতা।

‘মৃগয়া’য় মিঠুন চক্রবর্তী
পত্রিকা: এটা কি মনে হয় সুপারস্টার হওয়ার ফলে মিঠুনের অভিনেতা-সত্তাটা কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়েছে?
মৃণাল: আমার ‘মৃগয়া’তে দারুণ অভিনয় করেছিল। তার পর সুপারস্টার হয়ে অন্য লাইনে চলে গেল, সেটা আলাদা কথা। তাতে ওর অভিনেতা-সত্তা একেবারেই ক্ষুণ্ণ হয়নি। ‘তাহাদের কথা’ এবং আরও বেশ কয়েকটা এমন ছবিতে খুবই ভাল অভিনয় করেছে। যা দেখে বোঝা যায় ও জাত অভিনেতা। ১৯৯২ নাগাদ ভেবেছিলাম মিঠুনকে নিয়ে একটা ছবি করব। ওকে খবর পাঠাতে উটি থেকে সোজা বাড়িতে এসে হাজির। বলল, ‘আপনি যেমন বলবেন আমি তেমন করব। শুধু শুটিংয়ের দু’মাস আগে জানিয়ে দিলেই হল’। আমি বললাম তোমার এখন পারিশ্রমিক যা, তা আমি দিতে পারব না। ও বলল, ‘আমাকে তিন হাজার টাকা দিলেই হবে। যেমন ‘মৃগয়া’র সময় দিয়েছিলেন। আর যে উপরি এক হাজার টাকা বখশিস দিয়েছিলেন সেটাও দিতে হবে না’। এমনই ছিল মিঠুনের উত্‌সাহ।

পত্রিকা: তা শেষ পর্যন্ত ছবিটা হয়ে উঠল না কেন?

মৃণাল: পরে ভাবলাম, করব না। হয়ে উঠল না আর কি।

পত্রিকা: নায়িকাদের মধ্যে এক নম্বর কে?

মৃণাল: নায়িকাদের এক নম্বর ঠিক করা যাবে না। স্মিতা-শাবানা দু’জনেই আছে। দু’জনেই অসামান্য। শাবানা যখন আমার ছবিতে বাঙালি অবিবাহিতা কন্যার রোলটা করতে এল, প্রথমেই আমার স্ত্রীর কাছ থেকে ওর আলমারির চাবি নিয়ে একটা শাড়ি বাছল। আর সেটা পরে ফেলল। শাবানা-কে টেক করার সময় একটা দৃশ্য দেখিয়েছিলামএই ভাবে চাইছি। ও সাত বার সাতটা আলাদা টেক দিল। দিয়ে বলল, কোনটা রাখবেন? প্রত্যেকটাই একই রকম ভাল। আর স্মিতা সাত বার অবিকল এক শট দিল। এক ইঞ্চিরও কোথাও কোনও তফাত নেই। কী অসাধারণ! এদের মধ্যে থেকে এক নম্বর বাছা সম্ভব নয়।

পত্রিকা: আপনি একই সঙ্গে এত সব ক্ল্যাসিক ছবির নির্মাতা। তবু একটা সমালোচনা থেকেই গিয়েছে যে আপনি মানুষটা আদ্যন্ত ফ্ল্যামবয়েন্ট আর দর্শনে রোমান্টিক হয়েও আপনার সিনেমায় কখনও বসন্তের কোকিল ডাকবে না। পূর্ণিমার চাঁদকে বরং দেখানো হবে ঝলসানো রুটি।

মৃণাল: চারপাশের পৃথিবীকে ঝলসানো রুটির মতোই দেখেছি। দেখেছি সেই রুটির ভেতর বসবাস করা মানুষকে। ‘খারিজ’ কান-য়ে রিলিজ হওয়ার পর কী প্রতিক্রিয়া! কী সাঙ্ঘাতিক রই্যাকশন। আর এক বার ১৯৭৮-এ কান-য়ে দেখা ফার্নান্দো সোলানাসের সঙ্গে। ‘ওকা উরি কথা’ সে বার ফর্টনাইট বিভাগের স্ক্রিনিংয়ে ছিল। আর্জেন্তিনার সোলানাস সেই ছবিটা দেখেছিলেন। সোলানাসের বলা কথাটা ওঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, ‘উই ফিয়ার পিস মোর দ্যান ওয়ার’। উনি বললেন, আমার ছবি দেখে নাকি খুব ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে এ তাঁর নিজের দেশেরই ছবি। দুঃখ-দারিদ্র, বিষণ্ণতা আর অন্ধকারের আস্তরণেই আজ তাঁর দেশ আচ্ছন্ন। এই রকম প্রতিক্রিয়া আগেও পেয়েছি যেখানে স্বৈরতন্ত্রের কদর্য অত্যাচার, ধরপাকড়, স্বাধীনতা হরণ আর আতঙ্ক ফুটিয়ে তোলা আমার ফিল্মের সঙ্গে দূরদেশের কেউ একাত্মতা খুঁজে পেয়েছে।

পত্রিকা: আজকের বঙ্গ রাজনীতি সম্পর্কে আপনার কী মত? আজীবন আপনি বাম সমর্থক। তবু জানতে চাই, কোথাও গিয়ে জ্যোতি বসু এবং বামফ্রন্ট সম্পর্কে আপনার মোহভঙ্গ হয়েছে কি না?

মৃণাল: আজকের রাজনৈতিক ডামাডোলে যেভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে ভাষার কোনও রকম তোয়াক্কা না করেই, সে সব দেখেশুনে সতর্ক হয়েই কথা বলতে হবে। ছাত্রজীবনে ছাত্র ফেডারেশন করেছি। রাজনৈতিক পরিবেশে জড়িয়ে পড়েছি। পুলিশের লাঠি খেয়েছি। জেলেও গিয়েছি এক-আধবার। এত কিছু ঘটনা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি সব কিছু। যখন লেফ্ট ফ্রন্ট সরকার গড়ল, অবশ্যই খুশি হয়েছিলাম। বহু বছর শাসনে থাকা লেফ্টের নানা কাজের মধ্যে ভাল লাগা আর না-লাগা, আমার নজর এড়ায়নি। পাপ জমা হয়েছে কমবেশি। যন্ত্রণাও পেয়েছি। প্রশ্নও করেছি। জ্যোতিবাবু তাঁর অনেক গুণের মধ্যেও কিছু কিছু অংশে দায়ী তো নিশ্চয়ই। যদিও বুদ্ধকে আমার খুব সিনসিয়ার মনে হয়েছে। ও যখন মুখ্যমন্ত্রী হল, আমি বলে এসেছিলাম, সাম ডে ইউ উইল বি আ লোনলি ম্যান। একটা কথা না বলে পারছি না, কাজে এবং ব্যবহারে জ্যোতিবাবু, বুদ্ধদেব আর তারও আগে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় অত্যন্ত সুসভ্য, সিভিলাইজড মানুষ ছিলেন। অথচ এদের সরকারের দু’বছর পেরোতে না পেরোতেই যা চলছে, কাজে-ব্যবহারে এমনকী ভাষার ঝাঁজেও, তাতে একটা কথা পরিষ্কার, নতুন দলটি মোটেও বিশ্বাস থেকে জেতেনি। বামফ্রন্ট সম্পর্কে মানুষের মনে যে একাধিক প্রশ্ন আর অভিমান জমা হচ্ছিল, সেই হাওয়ায় জিতেছে। বিশ্বাস থেকে নয়। স্রেফ নেগেটিভ ভোটে জিতেছে। লোকে চেয়েছে বামফ্রন্ট যেন না আসে। অন্য কিছু হোক। বদল হোক। এখন দেখা যাক ভবিষ্যতের পশ্চিমবাংলায় কী হয়!

পত্রিকা: রাজ্যের হালফিলের বিপযর্য়ের জন্য কাকে দায়ী করবেন?
মৃণাল: প্রাথমিক ভাবে অবশ্যই লেফ্ট ফ্রন্ট সরকারকে দায়ী করব। তারা গোলমাল করেছিল বলেই আজ এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।

পত্রিকা: চলচ্চিত্র উত্‌সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনি আর আসেন না কেন?

মৃণাল: না, যাব না। এই গভর্মেন্টের আমলে আমি যাব না।

পত্রিকা: কেন? আপনাকে তো মমতা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন?

মৃণাল: সেটা পাঠিয়েছে। আমাকে বারবার বলেছিল। লোক পাঠিয়েছে। কিন্তু আমার যাওয়ার শখ নেই। ছবি দেখতে আমি যাই। আবার যাব। ছবির সঙ্গে তো আমার কোনও বিরোধ নেই।

পত্রিকা: সরকার যদি কোনও সম্মান নিতে বলে বঙ্গভূষণ বা এই জাতীয় কিছু?

মৃণাল: সে সব নেব না, টাকা দিলেও নেব না। সৌমিত্র তো এদের সরকারের কোনও অনুষ্ঠানে একবার গেছিল। আমি বললাম, কেন গেলে? পুরস্কার পেলে নাকি? ও হেসে বলল, “দু’লাখ পেয়েছি।” তবে সে দিন দেখলাম সৌমিত্র আবার বলছে, কোন একটা অ্যাওয়ার্ড নিতে চায় না।

পত্রিকা: মৃত্যুর কথা কখনও ভাবেনটাবেন?

মৃণাল: কখনও ভাবিনি। মানিকবাবু সেই বলেছিলেন না, কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত মৃত্যুর কথা ভাবার সময় কোথায়?

পত্রিকা: মৃত্যুর প্রতি বরাবরই এমন মনোভাব?

মৃণাল: মরার কথা ভাবতেই শিখিনি।

পত্রিকা: সব কিছু খানটান?

মৃণাল: হ্যাঁ, মোটামুটি।

পত্রিকা: সুগার?

মৃণাল: নেই।

পত্রিকা: বিপি?

মৃণাল: নর্ম্যাল। ১৩০ বাই ৮০।

পত্রিকা: এই যে এত বছর একই রকম মনেপ্রাণে এভারগ্রিন থেকে যেতে পারা, রহস্য কী?

মৃণাল: জীবনকে অবিরাম ভালবেসে যাওয়া।
আজীবন সঙ্গী গীতা সেন
পত্রিকা: পৃথিবীর এত সব প্রান্তে গিয়েছেন। চ্যাপলিনের নাতনি থেকে আরও কত সব আন্তর্জাতিক খ্যাত নায়িকার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে। ‘বিশেষ’ প্রেমট্রেম হয়নি?
মৃণাল: নাহ্।

পত্রিকা: কী যে বলেন!

মৃণাল: গীতাকে বিয়ে করি সাত বছর কোর্টশিপের পর। এর বাইরে আর ঘেঁষিনি। ভাব হয়েছে অনেক। কিন্তু ওইটুকুই।

পত্রিকা: মৃত্যু পরবর্তী কালে লোকে আপনাকে কী ভাবে মনে রাখুক চান?

মৃণাল: এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে যে মানুষকে ভালবাসতে জানত। যে মানুষকে ভালবাসার উষ্ণতাকে বুঝতে জানত।

পত্রিকা: আজ থেকে পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বাদে মৃণাল সেনের কাজ কী ভাবে স্মরণ করা যাবে বলে নব্বই ছোঁয়া মৃণাল সেনের মনে হয়?

মৃণাল: জানি না। সে জন্যই মাঝে মাঝে কৌতূহল হয় যদি উঁকি দিয়ে দেখতে পারতাম, কে কী বলছে-টলছে তখন আমার সম্পর্কে!

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.