|
|
|
|
মৃণাল ভুবন |
ডাকসাইটে কোনও আমলার কাহিনি নয়। যার পদবি সোম। একান্তই মৃণাল সেন-য়ের নিজস্ব জগত্।
যেখানে ৯০ বছরের
জন্মদিনের
দু’দিন আগেও স্টাডি রুমে তাঁকে ভিড় করে থাকে
অপ্সরা
আর দেবদূতরা। সেই ভুবন প্রত্যক্ষ করে এলেন
গৌতম ভট্টাচার্য |
আচ্ছা এখনও পাশের ছবিটার মতো মইতে ওঠেন? উঠলে, সাহায্যকারী কেউ থাকে-টাকে তো?
সেন বাড়িতে দু’দিন পাঁচ ঘণ্টার ওপর কাটিয়ে-টাটিয়েও আবিষ্কার করছি, প্রশ্নটা করা হয়ে ওঠেনি!
দোষটা একান্তই সাংবাদিকের নয়। বিস্ময়মিশ্রিত অভিজ্ঞতারও। খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে মাথা থেকে আপনিই ডিলিট হয়ে গিয়েছিল।
আসলে নব্বই বছরের থুত্থুড়ে বৃদ্ধকে ইন্টারভিউ করতে যাওয়ার আগে যে সব ঝঞ্ঝাটের জন্য মনে মনে প্রস্তুত থাকতে হয়, সেগুলো ল্যাপটপে কম্পোজ করা জিনিসের ব্যাক আপ রাখার মতোই অতি গুরুত্বপূর্ণ সব শর্ত। এই সব ইন্টারভিউতে পৌঁছবার সময় অনিবার্য ভাবে সেই টেনশনগুলো ভিড় করে আসে।
১) প্রশ্নগুলো যথাসম্ভব ছোট রাখতে হবে। বৃদ্ধ-ব্রেন লম্বা প্রশ্ন মনে রাখতে না পেরে উত্তরের খেই হারিয়ে ফেলতে পারে। সেটা হতে দেওয়া যাবে না।
২) সঙ্গে টেপ রেকর্ডার অতি অবশ্য। কিন্তু সেটা প্রয়োজন দেখলেই দ্রুত সুইচ অফ করতে হবে। কারণ বৃদ্ধ প্রসঙ্গান্তরে যাবেই একটা কথা বলতে গিয়ে আরেকটায়। অবশ্যই সেটা এত দীর্ঘ চলবে অথচ সাক্ষাত্কারের কোনও কাজেই আসবে না যে, খামোখা টেপের ব্যাটারি পুড়িয়ে লাভ নেই।
৩) কথাবার্তা যতটা পারা যায় দ্রুত সারতে হবে। এই বয়সি লোকেরা হঠাত্ হঠাত্ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সত্যজিত্ রায়ের প্রশ্নটা তার মানে স্পর্শকাতর হলেও দেরিতে আনা যাবে না।
৪) প্রথম দিন খালি হাতে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। এই বয়সি মানুষ প্রথমত অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে এটাই মনে রাখতে পারে না। হঠাত্ বলতে পারে আমি তো বলিনি ইন্টারভিউ দেব। তার পর সামান্য শারীরিক ঝটকায় বেচাল হয়ে পড়ে। তখন সব প্ল্যান প্রোগ্রাম ভেস্তে যায়।
৫) প্রথম দিন সৌজন্যসূচক মিষ্টির বাক্স-টাক্স নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। এই বয়সি লোক তা-ও এত স্ট্রেস নিয়েছে জীবনে। সেন পদবির সঙ্গে নির্ঘাত ‘সুগার’ উপাধিও জুড়েছে। মিষ্টির বাক্স বরং অভিসম্পাতের দৃষ্টি আমন্ত্রণ জানাতে পারে। যা ইন্টারভিউয়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেও উপকারী হবে না। তার চেয়ে বই নিয়ে যাওয়া ‘সেফ’।
৬) সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা হতে পারে লোকটা এমনিতেই ইন্টারভিউ দিতে চাইছে না। আবার সামনে টেপ ধরলে দ্রুত গোটা ব্যাপারটাই মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র হয়ে যেতে পারে ‘খারিজ’। অতএব হাতে থাকছে, ওকে দেখে কী মনে হল এই ইম্প্রেশনমূলক জন্মদিনের কপি। কিছু ক্ষণ যদি বসতে দেয়, সেটাই একমাত্র নিশ্চিত...
...মৃণাল সেন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পাঁচতলার দক্ষিণমুখো ঘরে ধুতি পাঞ্জাবির অকৃত্রিম ট্রেডমার্ক বেশে। বেলতলার বাড়িটাই বাঙালি ফিল্ম জগতের কাছে পরিচিত। যেখানে টানা আটত্রিশ বছর ছিলেন। এই আস্তানাটায় বাস সামান্য কয়েক বছর ৩৮ নম্বর পদ্মপুকুর রোড। ফ্ল্যাটে ঢুকেই ডান দিকে স্টাডি। তপ্ত বৈশাখে দশ বাই দশ সেই ঘরটায় অনর্গল এসি চলে। কিন্তু এটাই বোঝা গেল মৃণাল ভুবন!
‘আমার ভুবন’। তাঁর শেষ ফিল্ম বানিয়েছেন এগারো বছর হয়ে গেল। কিন্তু এই ঘরটায় মানুষটার চলাফেরা আর অভিব্যক্তি পরিষ্কার বোঝাচ্ছে এখানে আজও নিভৃতে শট নেন। উপচে পড়া প্যাশন আর টেকনিক্যাল খুঁতখঁুতুনি নিয়ে দাঁড়ান লেন্সের পিছনে। সব শট যে ফিল্মের হতে হবে কে বলেছে! এই যে ঘরে কাতারে কাতারে রাখা ডিকশনারিগুলো সন্দেহ নিরসনের জন্য আজও টেনে নেন। এনসাইক্লোপিডিয়ার ওপর ঝুঁকে পড়েন প্রতিনিয়ত। ডিটেলসের প্রতি বরাবরের যে ঝোঁক, সেটা এই বয়েসে বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও তো একটা শট। এই বয়েসে অনবরত লম্বা লম্বা মেল চেক করেন। নিজে বসে মেল পাঠান। ‘টেলিগ্রাফ’য়ে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর লেখা অসম্ভব পছন্দ হওয়ায় প্রাক্তন রাজ্যপালকে কিনা মেল করেছেন মাঝরাত্তিরে। সেটাও তো একটা শট। এমনিতে প্রাণশক্তিতে ছাপ ফেলতে না পারুক, বিশ্বখ্যাত পরিচালকের চিন্তাশক্তিতে বয়স অবশ্যই কিন্তু বাম্প বসিয়েছে। প্রসঙ্গ থেকে দুম করে প্রসঙ্গান্তরে চলে যান খেই হারিয়ে। বক্তব্যের ট্র্যাফিকে লাল সিগনাল এসে যায় অতর্কিতে। কিন্তু জীবনের প্রতি মনোভাব এমনই ঋজু যে যানজটের মুখ খুলে যায় দ্রুত। তখন ফের মনে হতে থাকে, আরে, এ তো অতীতের মতোই। টেক নেওয়া চলছে চশমা পরা দীর্ঘদেহী মানুষটার। ওয়ান, টু, থ্রি... |
|
‘খণ্ডহর’য়ের লোকেশনে |
প্রখর শরীরী ভাষা আর বাঙালি ভদ্রলোকের প্রতিবাদী মননে পাকাচুলো তিনি আজও যখন উত্তেজিত ভাবে বলছেন, “কী চলছে সব পশ্চিমবঙ্গে! অ্যাঁ। আমার বয়েস থাকলে এই রকম রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে ছবি বানাতাম। কালেক্টিভ মিডিওক্রিসির যুগ এসেছে আজ। কী বামফ্রন্ট কী তৃণমূল।” তখন মনে হয় এটাও কী অসাধারণ ফ্রেম। অ্যাপারেচারটা কেউ ঠিক করুক না।
মানুষটা নিজেই সম্মিলিত নুন, ম্যাটিনি, ইভনিং, নাইট শো। গোটা জীবন সিডি করা সম্ভব একটা গোটা দিনের চলচ্চিত্রে। জোড়াসাঁকোতে বাঙালির ‘আঁধার’ নেমে আসার দিনে যিনি সেই বিপন্নতা আছড়ে পড়ার বিহ্বল প্রত্যক্ষদর্শী। যাঁর ছোটবেলায় মুহ্যমান দাঁতের ব্যথার উন্নতি করে দিয়েছিল ফরিদপুরের বাড়ির অতিথি সুভাষচন্দ্র বসু নামক ব্যক্তির প্রেসক্রিপশন! যাঁর অন্যতম বন্ধুর নাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। যাঁর যথেষ্ট পরিচয় জাঁ লুক গোদারের সঙ্গে। তিনিই যখন টাইপরাইটারের মতো প্রাগৈতিহাসিক সম্পর্কে আবদ্ধ না থেকে ‘একদিন অচানক’ নতুন প্রযুক্তির বন্ধুত্বকামী হন। তখন জীবনের নবম দশকেও ইন্টারভিউকামী পর্যটকের মনে হতে থাকে, দিনে সর্বক্ষণের সঙ্গী ল্যাপটপটাই আজ তাঁর নতুন অপ্সরা। আর ঘরের আলমারিতে থাকা বইগুলো গোটা জীবন যেমন ছিল দেবদূতের মতো। বারবার বলার মানে হয় না দক্ষিণমুখো ঘরটাই মৃণাল সেনের ভুবন! যেখানে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভ হয়ে জীবন শুরু করা তিনি শু্যটিং করে চলেন সবার অলক্ষ্যে ‘একদিন প্রতিদিন’। টেবিলের ওপর বনলতা সেন। প্রথম দিন বইটা চোখে পড়েনি। বললাম, আবার নতুন করে বনলতা সেন পড়ছেন? “না না। দিয়ে গেছিল। বনলতা সেনের ইংরেজি অনুবাদ। পড়লাম। হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। জীবনানন্দ কি ট্রান্সলেট করা যায়? ফর দ্যাট ম্যাটার কবিতার কি অনুবাদ হয়?” চিন্তার নতুন জগতে ডুব দিলেন মৃণাল। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েই দ্রুত ফিরে আসা, “আইপিএল দেখছি। গাওস্কর ঠিক বলেছিলেন সচিনের ফুটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছে। সম্মান নিয়ে ওর এখন চলে যাওয়াই উচিত। থামতে জানতে হয় আসলে।” যখন বলছেন তখনও তো বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক শট টেক করার ওয়াকিং স্টিলসেই মনে হচ্ছে। কে বলবে তাঁর শেষ ছবি যখন বানিয়েছেন লোকে ইন্টারনেটের নাম শোনেনি। এর পর সৌমিত্র-নাসিরকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু প্রযোজকের ব্ল্যাঙ্ক চেক পেয়েও বহু ভেবেটেবে আর নতুন ছবিতে হাত দেওয়া হয়নি। |
|
বন্ধের কলকাতায়। সৌজন্য: অশোক দাশগুপ্ত |
জানতে চাই মৃত্যুভয় হয় না আপনার? “ধুর, মানিকবাবু বলেছিলেন না, কাজ নিয়ে রয়েছি, মৃত্যুর কথা ভাবার সময় কোথায় মশাই।” শুনে মনে হল, মৃত্যুদর্শনে কি তাহলে কোথাও একত্র হয়ে গেলেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরিচালক। জীবন যা পারেনি, মৃত্যু সেই ঐক্য এনে দিচ্ছে। আহা, উত্তরটাই তো অতিস্মরণীয় একটা শট।
এ বার বাড়ির কেউ প্লেটে মিষ্টি আর চা নিয়ে আবির্ভূত। প্লেট থেকে গোলাপি মিষ্টি তুলে নিয়ে কামড় দিলেন মৃণাল সেন। “ভাল করেছে। খাও না। নকুড়ের।”
সে কি আপনার সুগার নেই? “না, না।” পেটের অসুখ-টসুখ? “ও খুচখাচ। এই বয়েসে যেমন থাকে-টাকে।” বিপি? ব্লাড প্রেসারও জানা গেল নর্মাল। হান্ড্রেড থার্টি বাই এইট্টি। দ্বিতীয় কামড়ে গোলাপি মিষ্টিটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সেটা শেষ করে উঠে, একটা পরামর্শও দিলেন, “‘শব্দ’ দেখো। দারুণ করেছে। কৌশিক কী করে আইডিয়াটা ভাবল কে জানে?”
সব দেখে-টেখে মনে হল মৃণাল ভুবনের চেয়ে সিনেমাটিক আর কী হতে পারে। মঙ্গলবার ৯০ বছর পূর্ণ করছেন। মৃণাল ভুবনের চারদিকে অভ্যর্থনা। উত্সব। ধুস, ৯০ তো তুচ্ছ একটা সংখ্যা। মৃণাল সেনকে মাপা যাচ্ছে না।
তিনি আসলে পৃথক ক্যাটেগরিতে আছেন। যার পাশে অ্যাস্টেরিক্সই বসে। নম্বর নয়। ক্যাটেগরির নাম জীবনযৌবন।
|
ছবি: সাত্যকি ঘোষ |
|
|
|
|
|