অঞ্জন-ব্যঞ্জন
অম্বল-মধুর কাহিনি
ল খেলেও একমাত্র বাঙালিরই বোধ হয় অ্যাসিডিটি হয়, যাকে আদর করে সে ডাকে অম্বল। এমন গৃহপালিত অসুখ আর কোনও জাতিতে এমন গুরুত্ব পায় কি না আমার জানা নেই। আদপে, কর্মনাশা বাঙালির জীবনে দুটো ব্যাধি, একটি আড্ডা, অন্যটি অবশ্যই অম্বল। কত ব্যবসাডুবি বা অফিস কামাই-এর অম্লমধুর কাহিনি এই অম্বলের সঙ্গে কম্বলের মতো জড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর জীবনে খ্যাতি থাকতে না পারে, অর্থ থাকতে না পারে, কিন্তু দীর্ঘ দিনের পোষ মানানো অম্বল বঙ্গজীবনের অঙ্গে অঙ্গে। আজ চারি দিকে যখন ভয়ঙ্কর সব নামের অসুখ কিলবিল করছে, তখনও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে এই নাছোড়বান্দা অম্বল।
মজার কথা হল, বাঙালির খেয়ে যেমন অম্বল হয়, না খেয়েও হয়, এমনকী পিত্ত পড়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে অম্বলবাবুর মা কিছু অন্তত মুখে দিতে বলেন! অর্থাৎ, খেয়ে অম্বল হল, আবার খেয়েই তার প্রতিকার। খাওয়া ব্যাপারটা কিন্তু কনস্ট্যান্ট। এই না হলে বাঙালি! কী খেলে অম্বল হয়, কী খেলে তা কাটে সেই গোলমেলে ব্যাপারে আমি ঢুকতে চাই না। আমার বক্তব্যটা জলের মতো স্পষ্ট। ব্যাপারটার মূলে আছে ভোজনপ্রিয় বাঙালির হজমবিলাসিতা। আগে বাঙালি পশ্চিমে বেড়াতে যেত হাওয়াবদলের জন্য। গিরিডি, যশিডি, শিমূলতলার জলে নাকি হাতি হজম হয়ে যেত, সে কালে সেটাই ছিল অম্বলের ভোম্বল দাওয়াই! আজ সেই হাওয়াবদল নেই, অম্বল এখন আর বিলাসিতাও নয়, নিছকই অ্যাসিডিটি।
অলংকরণ: দেবাশীষ দেব
আমার এক বন্ধুর গল্প। তাকে তার আর এক বন্ধু নাকি বলেছিল, শশা আর মুড়ি অম্বলের যম। বেচারি, দিন-রাতের ভাত খাওয়া ছেড়ে নিয়ম করে তাই খেয়েই দিন কাটাচ্ছিল। হঠাৎ, এক দিন আয়নায় নিজের চেহারা দেখে সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় এবং তার পর থেকে আবার নর্ম্যাল রুটিনে ফিরে আসে। অম্বল ব্যাপারটা যদিও আর ফিরে আসেনি। আর এক বন্ধুপত্নী তো এক কাঠি ওপরে। তার অম্বল কাটানোর এক মোক্ষম ওষুধ: বেদম টক জল দিয়ে টপাটপ কুড়িটা ফুচকা খেয়ে ফেলুন, বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাবে। এ হেন দুঃসাহসিক থেরাপির গ্যারান্টি আমি না দিলেও, সেই মহিলা কিন্তু রীতিমতো বহু দিন ধরেই দিয়ে আসছেন।
বাজে কথা থাক। কাজের কথায় ফিরি। আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে আমি এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম এই অম্বলের বিষয়ে। সে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিল, ওটা বাঙালির মনের অসুখ, বুঝলি। নিরানব্বই শতাংশ বাঙালিই এই মানসিক রোগের শিকার। ব্যাপারটা তখন বুঝিনি, আজ এই পঞ্চাশের কোঠায় দাঁড়িয়ে বেশ বুঝতে পারি কথাটার সত্যতা। আমি দিনের মধ্যে নানা রকম আগডুম-বাগডুম জিনিস খেয়েও কখনও কিন্তু এই অম্বলের পাল্লায় পড়িনি। আসলে, কথায় বলে না, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়! তাই কারও অম্বল সয়, কারও সয় না।
বাংলায় একটা বাগধারা আছে, ঝালে-ঝোলে-অম্বলে বাঙালি, যেখানে অম্বল রীতিমতো মহিমান্বিত। অম্বল অর্থাৎ টক না থাকলে বাঙালির আহার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শেষপাতের এই অম্ল রেশ বাঙালির যুগজয়ী ফ্লেভার। তাই, অম্বল মানে কারও কাছে যেমন চোঁয়া ঢেঁকুর, অর্থান্তরে, কারও কাছে বড় উপাদেয় একটি পদও। তাই, বাঙালি ছাড়া যেমন কারও অম্বল হয় না, অম্বল ছাড়াও কিন্তু বাঙালি হয় না!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.