ব্যাগ গুছিয়ে...
উদ্ধত যত শাখার শিখরে...
কাশ বলল “জায়গাটা দেখেছিস, মরতে যদি হয় বুঝলি এমনই একটা কোথাও...।” দেখলাম। চার পাশে সাদা রডোডেনড্রনের প্রায় একই উচ্চতার অসংখ্য গাছের সারি। সামনে একটু জায়গায় জটলা করে চার-পাঁচটা লাল আর গোলাপি রডোডেনড্রনের গাছ। মাটি লালে লাল হয়ে আছে ঝরা ফুলের পাপড়িতে। এরই ব্যাকড্রপে সিকিভাগ আকাশ জুড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে মহতী কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিকিমের আরাধ্য দেবতাত্মা।
“আলটপকা মারা পড়লে ছাইয়ের শেষটুকু গঙ্গায় না ফেলে, এক মুঠো ওই গাছগুলোর তালাটায় ছড়িয়ে দিস ভাই।” এ বার আর উত্তর না দিয়ে পারলাম না। বললাম, “কী রে তুই! এমন একটা আশ্চর্য জায়গায় এসে শুরুতেই মরার চিন্তা করছিস!” আকাশ একগাল হেসে বলল, “তোদের ভাবনার ধারাটা বড়ই সঙ্কীর্ণ। এ মরা কি সত্যি সত্যিই মৃত্যুচিন্তা নাকি! এমন জায়গায় মরতে পেলে দুঃখ থাকে না। তোর মনে হচ্ছে না, হেঁটে হেঁটে চলে যাই এই রডোডেনড্রনের পথ ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘার গা বেয়ে...কোনও কালে আর না ফিরলেই বা কী?”
সংসারী মানুষের না ফিরলে অনেক কিছু, সে কথা এই পাগলকে বোঝায় কে? তবে হ্যাঁ, এই অনন্ত সুন্দরের মধ্যে দাঁড়িয়ে এ রকম একটা মহাপ্রস্থানিক বোধ মাঝেমধ্যে ঘোর সংসারীকেও আচ্ছন্ন করে। গ্রীষ্মের বার্সে রূপে অনন্য। এক সময়ে বার্সের পরিচিতিই ছিল রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি হিসেবে। পরে তা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের মর্যাদা পেয়েছে। যাঁরা বিগত আশি-নব্বইয়ের দশকে বার্সে এসেছেন, তাঁরা জায়গাটাকে ‘ভার্সে’ নামে চিনতেন। পরে খাতায়-কলমে সরকারি ‘বার্সে’ নামটাই টিকে গেছে। স্থানীয় মানুষ কেউ কেউ বলেন, বার্সে কথাটা বর্ষা থেকে এসেছে। সত্যি-মিথ্যে যাই হোক না কেন, বার্সেবনে বর্ষার প্রাবল্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
রডোডেনড্রন ছাড়া সেলিব্রিটি বন্যপ্রাণ বলতে রেড পান্ডা আর ক্রিমসন ট্র্যাগোপান। হিমালয়ান ব্ল্যাক বেয়ার, চিতাবাঘ, হরিণ, বনশুয়োর আর বুনো কুকুরও আছে। তবে সে সব দেখা ভারী শক্ত। প্রাণ ভরে দেখা যায় ল্যাজঝোলা ইয়েলো-বিল্ড ব্লু ম্যাগপাই আর গাছের ডালে ডালে ছোটবড় রং-বাহারি হাজারটা পাখি। আস্ত রামধনুটাই যেন রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা জঙ্গলে। বার্সের অভয়ারণ্য যদিও হিলে থেকেই শুরু, জঙ্গলের মোটামুটি মাঝামাঝি একটা জড়ো করা পাথরের স্তূপকে স্থানীয় বহু মানুষ দেবস্থান জ্ঞানে পুজো দিতে আসেন। অভয়ারণ্যের মধ্যে স্থায়ী থাকার জায়গা একমাত্র এখানেই আর বার্সে বলতে সাধারণত এই বিশেষ স্থানটাকেই বোঝানো হয়। এখান থেকে আরও তিন চারটে ট্রেকিং রুট বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। তার মধ্যে মোটামুটি চালু দুটো রুটের একটা গেছে সোরেং, অন্যটা ডেনটাম।
বার্সের থাকার জায়গা ‘গুরাস কুঞ্জ’ থেকে আড়াইশো মিটার মতো দূরে ‘বার্সেটপ’। একটা অনুচ্চ সমতল-শীর্ষ, যেখানে দাঁড়ালে উত্তরে অবারিত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দক্ষিণ ঢালে অনেকটা নীচ পর্যন্ত পাহাড়, জঙ্গল আর রাম্মাম উপত্যকার একটা অংশ চোখে পড়ে। কাঞ্চনজঙ্ঘা গুরাস কুঞ্জের সামনে থেকেও খোলা। পরিষ্কার আবহাওয়ায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে দেখা যায় পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ-শোভিত বিস্তৃত ম্যাসিফের পুরোটাই। গুরাস কুঞ্জের ঠিক চার দিকে পাহাড়ের এক একটা ঢালে শুধুই রডোডেনড্রন। অধিকাংশই সাদা রডোডেনড্রন, তবে মাঝে মধ্যেই দু’-দশটা লাল, গোলাপি আর মিশ্র রঙের ফুলের গাছ। ট্রেক রুট বরাবর দু’পাশে ফার্নের ঝাড় আর জায়গায় জায়গায় গোছবাঁধা প্রিমুলা। মাটি-ঘেঁষা ঝোপে টুকটুকে লাল বুনো স্ট্রবেরির পিছুটান। রডোডেনড্রনের জঙ্গলে পায়ের তলায় পরতে পরতে পুরু পাতার গালচে। শব্দহীন, ছায়াময়, নিবিড় প্রশান্তি।
অভয়ারণ্য থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে চোখে পড়ল প্রবেশ-তোরণের উল্টো দিকে লেখা ‘ইউ আর ওয়েলকাম এগেন...’। বললাম, আকাশ, “তোকে আসতে লিখেছে আবার...।”
আকাশ পাইনপাতার আবডালে মুখ লুকোনো সূর্যের মতো টুক করে হেসে দিয়ে বলল, “অত বার বার বলার কী আছে। বললাম তো, এখান থেকে আর বেরোবোই না একদিন।”
কী ভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে বাসে বা শেয়ার গাড়িতে জোরথাং (৮২কিমি)।
জোরথাং থেকে গাড়ি ভাড়া করে হিলে (৫৫কিমি)। বার্সে যেতে হলে অন্তত
৪ কিলোমিটার ট্রেক করতেই হবে। হাঁটা বলতে খুব চড়াই উতরাই নেই।
পথও ভাল। আবার জোরথাং থেকে (৩০কিমি) পর্যন্ত শেয়ার গাড়িও যায়।
কখন যাবেন
সেরা সময় এপ্রিল-মে কিংবা অক্টোবর। বরফে হাঁটার ইচ্ছে থাকলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। অভয়ারণ্যে
ভ্রমণের অনুমতি হিলে থেকে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে হিলে থেকেই পোর্টার পাওয়া যেতে পারে।
ভিতরে কোনও দোকানপাট নেই। থাকা-খাওয়া বার্সেতেই সম্পূর্ণ বেসরকারি বন্দোবস্তে।

সঙ্গে নেবেন : প্রয়োজনীয় ওষুধ, টর্চ, মোমবাতি। সামান্য অতিরিক্ত শীতবস্ত্র নিয়ে গেলে ভাল।
কোথায় থাকবেন
হিলেতেও মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে দু-একটা। তবে বার্সেতে
অন্তত দুটো রাত না কাটালে জায়গাটার মাহাত্ম্য বোঝা যায় না।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.