|
|
|
|
বনশল বিদায়, দলের চাপে ছাঁটাই অশ্বিনীও
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি |
অশুভ যোগ কাটাতে আজ দুপুরেই বাড়িতে হোমযজ্ঞ করে পাঁঠা বলি দিয়েছিলেন পবনকুমার বনশল। তবু হাড়িকাঠ থেকে মন্ত্রিত্ব বাঁচাতে পারলেন না। ঘুষকাণ্ডের অভিযোগে রেলমন্ত্রীর পদ ছাড়তেই হল তাঁকে। একই দিন কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআইয়ের তদন্তে হস্তক্ষেপ করায় সুপ্রিম কোর্টের তিরস্কারের জেরে বিদায় নিতে হল আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমারকে। কর্নাটক জয় করে মনোবল বাড়িয়ে নেওয়ার দু’দিন পরেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দুর্নীতির দুই মুখকে সরিয়ে ভাবমূর্তি ঘষামাজা করতে চাইল কংগ্রেস।
ঘুষকাণ্ডে পবন বনশলের নাম যে ভাবে জড়িয়েছিল, তাতে তাঁর বিদায় এক প্রকার নিশ্চিতই ছিল বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। ওয়েস্টার্ন রেলের জেনারেল ম্যানেজার মহেশ কুমারকে রেল বোর্ডে শাঁসালো পদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য মোটা টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন পবনের ভাগ্নে বিজয় সিঙ্গলা। সিবিআই সেটা হাতেনাতে ধরে ফেলার পর তদন্তে উঠে আসতে থাকে মামা-ভাগ্নের কাণ্ডকারখানা।
অশ্বিনী কুমারকে সরানোর ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি ছিল বলেই সরকারি সূত্রের খবর। মনমোহনের যুক্তি ছিল, আইনমন্ত্রী সরাসরি দুর্নীতিতে যুক্ত নন। তা ছাড়া, শীর্ষ আদালত আইনমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের যুগ্মসচিবকেও তিরস্কার করেছে। অশ্বিনীকে সরালে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের দোষও কার্যত কবুল করে নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সামনে আর কোনও ঢাল থাকে না। তাই অশ্বিনীকে বড়জোর অন্য মন্ত্রকে সরানোর পক্ষপাতী ছিলেন মনমোহন। সনিয়া গাঁধী অশ্বিনীকে সরিয়ে দিতেই চাইছিলেন। একই দাবি উঠছিল দলের একটা বড় অংশের ভিতর থেকে। |
|
|
পবনকুমার বনশল |
অশ্বিনী কুমার |
|
তা সত্ত্বেও পবন-অশ্বিনী যে এত দিন টিকে ছিলেন, তার কারণ কর্নাটকে ভোট। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছিলেন, দুই মন্ত্রীকে সরালে প্রকারান্তরে তাঁদের দোষ স্বীকার করে নেওয়া হবে। এবং ভোটে তার প্রভাব পড়তে পারে। তাই কংগ্রেস নেতারা অনেকেই ঘরোয়া আলোচনায় বলছিলেন, দু’টো দিন সবুর করুন। কর্নাটকে দল জিতবে। তার পর মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিয়েই পবন-অশ্বিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন সনিয়া।
বস্তুত ঘটেছেও তাই। আজ কর্নাটকে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের বৈঠক বসতেই দিল্লিতে পবন বিদায়ের আবহসঙ্গীত শুরু হয়ে যায়। বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেস মুখপাত্র ভক্তচরণ দাস বলেন, “কর্নাটক ভোটে বিপুল জনাদেশ পাওয়ায় মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের দায় রয়েছে কংগ্রেসের। নিশ্চিন্ত থাকুন, কোনও রকম দুর্নীতি ও অনিয়ম সনিয়া গাঁধী কখনও বরদাস্ত করেননি, ভবিষ্যতেও করবেন না।”
এর আধ ঘণ্টা পরেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেন সনিয়া। সাত নম্বর রেস কোর্স রোডে সেই বৈঠক যখন চলছে, পবন তখন রেল মন্ত্রকে আসেন। সেখানে কাগজপত্র গোছানোর আগেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে জানানো হয়, রেলমন্ত্রীর ইস্তফা চাওয়া হয়েছে। রাত ন’টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেন পবন।
অশ্বিনীকে ঘিরে দল ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে টানাপোড়েন অবশ্য আর একটু দীর্ঘায়িত হয়। মনমোহন-সনিয়া বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যান কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী সচিন পায়লট এবং সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। কংগ্রেস সূত্রে খবর, মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান নেতা, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি ও দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাকে দিয়ে অশ্বিনীকে সরানোর জন্য মনমোহনের উপরে চাপ সৃষ্টি করেন সনিয়া। তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, দল ও সরকারের সর্বস্তরেই আইনমন্ত্রীকে সরানোর দাবি প্রবল। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পর সাধারণ মানুষের ধারণা, অশ্বিনীও দোষী। তিনি সিবিআইয়ের রিপোর্ট লঘু করে দুর্নীতি আড়াল করতে চেয়েছেন। রাজনীতিতে যে হেতু ধারণাটাই সব, সে হেতু লোকসভা ভোটের আগে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে অশ্বিনীকে সরিয়ে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেই চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতে হয় মনমোহনকে। কংগ্রেস মুখপাত্ররা অবশ্য সনিয়া-মনমোহন টানাপোড়েনের কথা স্বীকার করছেন না। তাঁদের বক্তব্য, কোনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠামাত্রই তাঁরা ব্যবস্থা নিয়েছেন। তা সে নটবর সিংহই হোন বা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বাণ। সুরেশ কলমডী হোন বা শশী তারুর।
প্রশাসনিক স্বচ্ছতার বার্তা দিতে আজই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সিবিআই-কে কী ভাবে স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করা যায়, তার উপায় খুঁজবে ওই মন্ত্রিগোষ্ঠী। কংগ্রেসের এক শীর্ষ স্থানীয় নেতা আজ বলেন, ২২ মে সরকারের চার বছর পূর্তি হচ্ছে। তার আগে সমস্ত দাগ মুছে নতুন করে একটা ধাক্কা দিতে চাইছেন সনিয়া-রাহুল। যাতে মানুষের আস্থা ফিরে পায় কংগ্রেস।
বিরোধীরা অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই সমালোচনার সুর আরও চড়িয়েছে। বিজেপি মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন বলেন, “চুরি করলে সাজা পেতে হবে, সেটাই দস্তুর। কিন্তু সেই সাজা দিতেই দেরি করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অশ্বিনীকে আড়াল করে তিনি নিজের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। আমরা তাঁরও ইস্তফা দাবি করছি।” বস্তুত, অশ্বিনী-বিদায়ের পরে প্রধানমন্ত্রীর সামনে আর কোনও ঢাল রইল না। বিরোধীরা এ বার সরাসরি তাঁকেই আক্রমণ করবে। কংগ্রেস সেই আক্রমণ কী ভাবে ঠেকায়, সেটাই দেখার।
কংগ্রেস ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, সনিয়া-রাহুলের পরামর্শে ২২ তারিখ বা তার আগে সাংবাদিক বৈঠক করতে পারেন মনমোহন। সেখানে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে দেশকে বার্তা দিতে পারেন তিনি।
পবন এবং অশ্বিনীর ইস্তফার পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবল নিয়েও জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাতে ঘি ঢেলেছেন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী মল্লিকার্জুন খার্গে। কর্নাটকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে মল্লিকার্জুনের নামও ছিল। কিন্তু সীড্ডারামাইয়া মুখ্যমন্ত্রী পদে মনোনীত হওয়ার পর মল্লিকার্জুন ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, তাঁকে রেলমন্ত্রী করা হবে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না কংগ্রেস সূত্র। বলা হচ্ছে, তাতে কর্নাটকে কংগ্রেসের ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। তা ছাড়া, লোকসভা ভোটে যে হেতু কর্নাটকে আসন বাড়াতে চাইছেন রাহুল, ফলে মল্লিকার্জুনকে রেলমন্ত্রী করা হতেই পারে।
শুধু রেলমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর শূন্যস্থান পূরণ নয়, মন্ত্রিসভায় আরও কিছু রদবদল হতে পারে বলে জানাচ্ছেন অনেক কংগ্রেস নেতা। তাঁরা বলছেন, কাল কংগ্রেসের কোর গ্রুপের বৈঠকের পর, পরশু রবিবার মন্ত্রিসভার রদবদল হয়ে যেতে পারে। কারণ, সোমবার উত্তর-পূর্বের দুই রাজ্যে তিন দিনের সফরে যাবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবার বুধবার অসম যাবেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে পরশু না-হলে বৃহস্পতিবারের আগে আর রদবদল সম্ভব নয়।
তবে যাবতীয় রদবদলের মূল যা উদ্দেশ্য, ভোটারদের মন জয় করা, তা কংগ্রেস পারবে কি না, তা সময়ই বলবে। দলের এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, অনেক খুঁজে পেতে পবন বনশলকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সনিয়া-মনমোহন। পবনের দুধ-সাদা কুর্তা পাজামায় কোনও দাগের খবর তখনও ছিল না। মিশুকে মানুষটার সম্পর্কে বিরোধীদেরও উচ্চ ধারণা ছিল। সুতরাং তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল রেলে সংস্কার এবং স্বচ্ছতা কায়েম করার কাজ। কিন্তু তিনি যা করলেন, তার পর আর কার উপরেই বা পুরোপুরি ভরসা করতে পারবে কংগ্রেস!
|
পুরনো খবর: দিনভর ঘরবন্দি বনশল, চাপ বাড়ছে অশ্বিনীর মন্ত্রক বদলেরও |
|
|
|
|
|