ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ছেড়ে পালাতে চাননি তিনি। আর সেটাই তাঁর একমাত্র অপরাধ বলে দাবি করছেন দেবযানী মুখোপাধ্যায়। এখন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে সংবাদমাধ্যম যে পরিমাণ রসালো খবর ছড়াচ্ছে, সেটা নিজের মানসম্মানের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করছেন তিনি।
শুক্রবার তাঁর আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতার মাধ্যমে সওয়া দু’পাতার একটি বিবৃতি দিয়েছেন সারদা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত দেবযানী। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, টাকা তোলা সংক্রান্ত কাজে তিনি কোনও দিনই জড়িত ছিলেন না। বছরখানেক আগে যখন বুঝতে পারেন, সুদীপ্ত অনৈতিক উপায়ে ব্যবসা করছেন, তখনই তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তার জেরেই তাঁকে ডিরেক্টরের পদ খোয়াতে হয়েছিল বলে দেবযানীর দাবি।
এ সব কথা দেবযানী সেই সময়েই পুলিশকে জানাননি কেন? তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে দেবযানীর বক্তব্য, তার অব্যবহিত পর থেকেই কোম্পানির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। সেই নিরিখেই সুদীপ্তকে ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। ২০১২-র শেষ থেকে বেতন না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি সংস্থার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে দেবযানীর দাবি। দেবযানী লিখেছেন, “কোম্পানিতে থাকাকালীন দেখেছি, সমাজের অনেক গণ্যমান্য লোক আমার বস সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছেন। কিন্তু যখন কোম্পানিতে গোলমাল শুরু হল, ওঁরা আর ফিরে তাকালেন না। ওঁদের আসল চেহারাটা তখন বেরিয়ে পড়ল। আমার একমাত্র ভুল, আমি মাঝপথে আমার বসকে ছেড়ে যেতে চাইনি।”
সুদীপ্তকে ছেড়ে না যাওয়ার সেই সিদ্ধান্তের কারণেই এখন তাঁর মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন দেবযানী। তাঁর আক্ষেপ, “আমি একটি বাঙালি মেয়ে। আমার পরিবারেরও যথেষ্ট সুনাম আছে। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।” দেবযানীর বক্তব্য, সুদীপ্তর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধুই পেশাদারি সম্পর্ক। আর পাঁচ জন বস এবং তাঁদের বিশ্বাসভাজন কর্মীর মতোই। “সেই সীমা আমি কখনও অতিক্রমের চেষ্টা করিনি। তাঁর সঙ্গে আমি ব্যবসার কাজে অনেক জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু কখনওই তাঁর সঙ্গে এক ঘরে থাকিনি। অথচ এখন এ সব নিয়েই যথেচ্ছ রসালো আলোচনা হচ্ছে। যা আমার সম্মানের প্রতি বিরাট আঘাত।” |
লিখিত বিবৃতিতে দেবযানী জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ১৫ হাজার টাকা বেতনে সারদার ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস শাখায় যোগ দেন। প্রথমে গুয়াহাটি, তার পরে কলকাতায়। দেবযানীর বক্তব্য, তিনিও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আর সকলের মতোই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে কাজে উন্নতি করা এবং সামাজিক মর্যাদায় উপরে ওঠার তাগিদ তাঁর ছিল। বস হিসেবে সুদীপ্তর নির্দেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। ২০০৮-এর জুলাই মাসেই দেবযানীকে সারদা রিয়েলটির ডিরেক্টর পদ দেওয়া হয়। কাজে দক্ষতা এবং একাগ্রতাকে সম্বল করেই তিনি পদ পান বলে দাবি করেছেন দেবযানী। সুদীপ্ত তাঁর উপরে নির্ভর করতে শুরু করেন, তাঁকে ব্যবসার কাজে সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু বস ও কর্মীর সম্পর্কের লক্ষ্মণরেখা কেউই কখনও লঙ্ঘন করেননি বলে দেবযানীর দাবি। সারদার হয়ে টাকা তোলার কোনও কাজকর্মের সঙ্গে তাঁর সংস্রব ছিল না বলেও দাবি করছেন তিনি। এমনকী দেবযানী এ-ও বলছেন যে, গত বছর থেকে সুদীপ্ত অসাধু উপায়ে ব্যবসা করছেন বলে টের পাওয়ার পর তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করে সরে আসেননি। শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মীর মতো বস-এর পাশে থেকে গিয়েছেন।
এ দিন জেরায় সুদীপ্ত স্বয়ং জানিয়েছেন, দেবযানীকে নিয়ে কাশ্মীর যাওয়ার পথে তিনি নেপালেও ঢুকেছিলেন। ১৭ এপ্রিল দু’জনে মিলে হলদোয়ানি থেকে কনকপুর সীমান্ত দিয়ে নেপালের ধাংরি গিয়েছিলেন। সেখানে এক দিন থাকার পর ফের উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরে ফিরে আসেন তাঁরা। সেখান থেকে শোনপথ ও কুলু হয়ে সোনমার্গে যান। নেপালে না-থেকে এ দেশে ফিরে এলেন কেন? স্পষ্ট জবাব দেননি সুদীপ্ত বা দেবযানী। তবে গোয়েন্দাদের ধারণা, নেপালে যাঁর আশ্রয়ে থাকার কথা ছিল, তিনি সম্ভবত শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন। সেই কারণেই নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দেশে ফেরেন দেবযানীরা।
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট সূত্রের খবর, মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে রাশভারী দেবযানীর ধারে-কাছে আসতে পারতেন না অনেকেই। সেই দেবযানী ইদানীং থানার মহিলা পুলিশ-কর্মীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। জেরার সময়েও তিনি তদন্তকারীদের যথেষ্ট সাহায্য করছেন বলে পুলিশ কর্তাদের দাবি। নিজের বিবৃতিতে পুলিশকে সাহায্য করার কথা ফলাও করে বলেছেন দেবযানীও। তাঁর ক্ষোভ মূলত সংবাদমাধ্যমের প্রতি। দেবযানীর কথায়, “মামলাটি বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমাকে নিয়ে যে সব আষাঢ়ে গল্প ছাড়া হচ্ছে, সেগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।”
|