ধুলো জমেছে টেবিলে। চেয়ারটাও অগোছালো। কাচের জানলা বেয়ে নেমে আসা ভারী পর্দাগুলোও আগের মতো টানটান নেই। সারদা গোষ্ঠীর সদর দফতর মিডল্যান্ড পার্কের ছ’তলার এই অফিসে যে অনেক দিন কেউ ঢোকেনি, তার প্রমাণ ছড়িয়ে সর্বত্র।
ক’দিন আগেও এই অফিসে তিনি ছিলেন ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’, সকলের সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়া ‘ম্যাডাম’। বৃহস্পতিবার সকালে সেই অফিসেই দেবযানী মুখোপাধ্যায় পা রাখলেন পুলিশ-পরিবৃত হয়ে। ক’দিন আগেও ওই ঘরের সমস্ত আসবাব মুছে টিপটপ করে রাখতেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন দেহরক্ষী। গাড়ি থেকে নেমে লিফটে চেপে ‘ম্যাডাম’ ওই ঘরে পৌঁছতেন কর্মীদের স্যালুট নিতে নিতে। রোজ বেলা ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত থাকতেন। তারপরে বেরিয়ে যেতেন অন্য অফিসে। ফিরে আসতেন গভীর রাতে। এ দিন তদন্তের স্বার্থে যখন সেই অফিসে তাঁকে নিয়ে গেল পুলিশ, তখন ছ’তলা বাড়িটা কার্যত হানাবাড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, নিজের ঘরে ঢুকে এ দিন আপাত ভাবে নির্লিপ্তই ছিলেন দেবযানী। এক পুলিশকর্তা বলেন, “কথা বলার ফাঁকে ঘরের চারদিকে চোখ বোলাচ্ছিলেন ঠিকই। তবে চুপচাপ। উদাসীন।” কতকটা অভ্যাসবশেই যেন টেবিলের ড্রয়ার টেনে পুলিশকে দেখালেন, একটা ইংরেজি বই আধখোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে শুধু এক বার পিছনে না তাকিয়ে পারলেন না। ভিতরের আবেগটা এক ঝলক ধরা পড়ে গেল তখনই। |
পুলিশ বলছে, সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের বিরুদ্ধেই আঙুল তুলছেন তাঁর ছায়াসঙ্গী দেবযানী। সাফারি সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে টাকা জমা করা কিংবা সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় নামা এ সব পদক্ষেপই সারদাকে ডুবিয়েছে বলে দেবযানীর বক্তব্য। সমাজের বিভিন্ন স্তরে সারদার প্রভাব বাড়ানোতেও তাঁর আপত্তি ছিল বলে দাবি করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে তাঁরই দেখানো গোপন আলমারি থেকে কয়েক বস্তা নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এ দিন বেলা ১০টা নাগাদ পুলিশের গাড়ি থেকে সারদার অফিসের সামনে নামেন দেবযানী। পরনে দামি শাড়ি, চড়া মেকআপ নেই, চেনাই যাচ্ছিল না এই দেবযানীকে। সাদামাঠা হলদে রঙের কামিজ, কালো দোপাট্টা ও কালচে সালোয়ার পরা ম্যাডামকে দৃশ্যতই বিধ্বস্ত লাগছিল।
গত সপ্তাহে সারদার দুই মহিলাকর্মীকে নিয়ে মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। তাঁরাই বলেছিলেন, ওই অফিসে সুদীপ্ত ও দেবযানীর ‘অ্যান্টি চেম্বারে’ আরও অনেক নথি মিলতে পারে। পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন ওই বাড়ির দোতলা, পাঁচতলা ও ছ’তলায় তল্লাশি চালিয়ে দু’বস্তা ফাইল, এক বস্তা সিডি-সহ প্রচুর জমির দলিল, হার্ড ডিস্ক, কম্পিউটার ও রবার স্ট্যাম্প বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন দেবযানীর সঙ্গে ওই সংস্থার এক সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকেও মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেবযানী আসার খবর পেয়ে অনেকেই মিডল্যান্ড পার্কের অফিসের সামনে ভিড় জমান। হাজির ছিলেন সারদার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একটি সংস্থার ম্যানেজার কৃষ্ণগোপাল দেবনাথও। সারদার কাছে তাঁর সংস্থার বকেয়া ৫৪ লক্ষ টাকা। বেলা দেড়টা নাগাদ তল্লাশি শেষ করে পুলিশ দেবযানীকে নিয়ে বেরনোমাত্র তাঁদের ঘিরে ভিড় জমে যায়। সেই ভিড় কাটিয়ে নিমেষে পুলিশ তাঁকে নিয়ে নিউটাউন থানার দিকে রওনা দেয়। |