অভিজ্ঞতা বা সিনিয়রিটিই যথেষ্ট নয়। হতে হবে রেলমন্ত্রী বা বোর্ডের কোনও শীর্ষ কর্তার কাছের লোক। অথবা ভরসা রাখতে হবে নগদ-নারায়ণে! তবেই ছাড়পত্র মিলতে পারে রেল বোর্ডের সদস্য হওয়ার।
অবশ্য শুধু রেল বোর্ডের সদস্য পদেই বা কেন, অভিযোগ উঠেছে, গত কয়েক বছর ধরে রেলের ১৭টি জোনের জেনারেল ম্যানেজারও নিয়োগ হয়েছে টাকা ও স্বজনপোষণের সমীকরণ মেনেই! ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন বহু অভিজ্ঞ অফিসার। রেল বোর্ডের সদস্য মহেশ কুমার ঘুষ-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়ায় এখন কার্যত বাঘ পড়েছে দুর্নীতিবাজদের পালে। মোটা টাকার বিনিময়ে রেলের পদ বিক্রি নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ায় এখন বোর্ড সদস্য নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে তৎপর হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ নিজেই। বর্তমান রেল বোর্ডে দু’টি শূন্য পদ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই দুই পদে নিয়োগের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি তদারকি করার জন্য নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত নথি চেয়ে পাঠিয়েছেন ক্যাবিনেট সচিব অজিতকুমার শেঠ।
রেল বোর্ড সদস্য (কর্মিবর্গ) মহেশ কুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ওই পদ পেয়েছেন রেলমন্ত্রী পবন বনশলের ভাগ্নে বিজয় সিঙ্গলাকে ঘুষ দিয়ে। অভিযোগ, মহেশ কুমারের মূল লক্ষ্য ছিল রেল বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল অবসর নিলে সেই পদ দখল করা। কিন্তু ঘুষ-কাণ্ডে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর ওই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে সাসপেন্ড করেছে মন্ত্রক। আপাতত বোডর্র্ সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) এস কে জৈনকে অস্থায়ী ভাবে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত মাসে অবসর নেন রেল বোর্ডের এক সদস্য (ট্রাফিক) কে কে শ্রীবাস্তব। সেই পদের দায়িত্ব এখন বোর্ড চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তলের হাতে।
বোর্ডের ওই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন দ্রুত কোনও যোগ্য অফিসারকে বসাতে চাইছে সরকার। কেন না রেলের দৈনন্দিন পরিচালন ব্যবস্থা দেখার দায়িত্বে থাকেন সদস্য ট্রাফিক। ওই দু’টি পদের জন্য অভিজ্ঞতা ও বয়সের দিক থেকে যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছেন ক্যাবিনেট সচিব। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “রেল বোর্ডকে কেবল তালিকা পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তার মধ্যে থেকে কে যোগ্য, তা ক্যাবিনেট সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় খতিয়ে দেখে নেবে বলে বার্তা দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যানকে। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও অফিসারের নামে কোনও ধরনের সুপারিশ গ্রাহ্য করা হবে না।” এর আগেও রেল বোর্ডের পক্ষ থেকে কোনও পদের জন্য একাধিক যোগ্য ব্যক্তির তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হত নিয়োগ সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটির কাছে। কিন্তু মন্ত্রী বা রেল মন্ত্রক কোন ব্যক্তিকে চাইছেন, তা-ও বুঝিয়ে দেওয়া হত বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই ‘ইচ্ছা’ রাখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্য ব্যক্তি বঞ্চিত হতেন। কিন্তু এখন ঘুষ-কাণ্ডের পর সে সব সুপারিশ শক্ত হাতে বন্ধ করতে চাইছে মন্ত্রক।
ঘুষ-কাণ্ড সামনে আসার পর রেল মন্ত্রক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জানায়, অভিজ্ঞতা ও বয়সের দিক থেকে সব চেয়ে প্রবীণ অফিসার হলেন মহেশ। নিয়ম মেনেই তাঁকে সদস্য কর্মিবর্গ পদে বসানো হয়েছে। কিন্তু রেলের নিয়োগ সংক্রান্ত তালিকা বলছে, ওই পদের জন্য বর্ষীয়ান অফিসার ছিলেন উত্তর-পশ্চিম রেলের জেনারেল ম্যানেজার আর সি অগ্রবাল। এমনকী, তিনি বর্তমান সদস্য (মেকানিক্যাল) অনুরেন্দ্র কুমারের থেকেও বয়সে প্রবীণ। মন্ত্রক সূত্রের একাংশের দাবি, অগ্রবাল বোর্ড সদস্য হওয়ার জন্য ঘুষ দিতে চাননি।
যোগ্যতা না থাকলেও কেবল অর্থ খরচ করে বা মন্ত্রীর সুনজরে থাকলেই যে বোর্ড সদস্য হওয়া যায় তা কোনও গোপন তথ্য নয় বলেই অভিযোগ এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল মহলের। যোগ্য অফিসারদের বঞ্চনা করা নিয়ে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল রেলের অফিসারদের মধ্যে। মহেশ কুমারের ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় গত সোমবার ক্যাবিনেট সচিব অজিতকুমার শেঠ ও প্রধানমন্ত্রী প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি পুলক চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি দেয় রেলের ফেডারেশন অফ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। জেনারেল ম্যানেজার থেকে বোর্ড সদস্য নিয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। নিয়োগে দুর্নীতি হচ্ছে। ফলে অফিসারদের মনোবল ভেঙে পড়েছে।
|