নীল নির্জনে ঠায় দাড়িয়ে চিত্রভানু
ছিবো বস্তির একদিকে সিকিম। টিনের বাড়িগুলি সুন্দর লাগে দেখতে। দিনভর সূর্যের আলোয় ঝলমল করে। অপূর্ব নীল নির্জনে দাঁড়িয়ে প্রতিমা দেবীর---চিত্রভানু।
অনেকে মনে করেন কবিগুরুর বাড়ি। মোটেও তা নয়। কবির ইচ্ছে ছিল। সেটা হয়ে ওঠেনি। তাঁর মৃত্যু পরে ওই বাড়ি তৈরি হয়। প্রতিমা দেবী শেষ বয়সে সেখানে থাকতেন। বাড়ির জমি লিজে নেওয়া হয়েছিল। লিজ গ্রাহক ছিলেন কবিগুরুর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী স্বয়ং। ঠিকানার উল্লেখ রয়েছে, পোস্ট অফিস শান্তিনিকেতন, বীরভূম। লিজের সময়কাল ১৯৪২ সাল থেকে ৯০ বছর। প্লট নম্বর এইচ/১২১, পাট্টার তারিখ ১২ মার্চ ১৯৪২। বার্ষিক খাজনা দেড়শো টাকা এক একরে। সেলামি দুশো টাকা।
১৯৪১ সালে কবিগুরু প্রয়াত হন। বাড়িটি প্রতিমা দেবীর একান্ত চেষ্টায় শেষ হয় ১৯৪৩ সালে। হরেক ফুলের বাগান তৈরি করা হয়। শান্তিনিকেতনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের স্টুডিও-র নামে বাড়ির নামকরণ হয় চিত্রভানু। এখানে তাঁদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। কবিগুরুর হাতের কাজ। কারুকাজে ভরা কাঠের টি টেবিল, লাঠি। আরও অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে ঘরের আনাচে-কানাচে।
চিত্রভানু এখন ঠাকুর পরিবারের হাতে নেই। ১৯৬৪ সালে রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের হাতে চলে যায়। এখন সেখানে নারী শিক্ষা কেন্দ্র। পাহাড় ও সমতলের মহিলাদের হাতের কাজ শেখানো হয়। উলের জিনিস বানানো, টেলারিং, কাটিং শোখানোর ব্যবস্থা আছে। হাতের কাজের প্রদর্শনী হয়। কাপড়ের ব্যাগ, বিছানার চাদর, গালিচা থেকে নানা সামগ্রী প্রদর্শনীতে থাকে। বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে।
চিত্রভানু রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য। কবি কালিম্পংয়ে চার বার যান। একান্ত ভাললাগার ওই পাহাড়ের অনেক কথা তাঁর চিঠি, কবিতা এবং অন্য লেখায় উঠে এসেছে। অনুরাগীরা এখানে কবিকে নতুন করে অনুভব করেন। কালিম্পং পাহাড়ে কবিগুরু প্রথম পা রাখেন ১৯৩৮ সালের ২৫ এপ্রিল। তখন তাঁর বয়স ৭৮ বছর। কবিকে নিয়ে গাড়ি যখন কালিম্পংয়ে পৌঁছয় তখন বেলা সাড়ে ১১টা হবে। তিনি গৌরীপুর ভবনে উঠেছিলেন। বাড়িটি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর। তিনি বাড়িটি কবিগুরুকে থাকার জন্য ছেড়ে দেন। সুন্দর পরিবেশ। প্রচুর আলো। দরজা জানালাগুলি বেশ বড় মাপের। বারান্দা থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথু লা। জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর বাগানের মালি বিষ্ণুলাল শর্মাকে কবির দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব দেন।
শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর আরও ভাল লেগেছিল এ ভেবে যে সে বার পঁচিশে বৈশাখ খুব শান্ত ভাবে কেটে যাবে। কবি ও অন্যরা জন্মদিন উপলক্ষে দেশি-বিদেশি কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানান। শহরের কিছু অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। ইচ্ছে প্রকাশ করায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কবির মিলিত হওয়ার দিন ঠিক হয় ১ মে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তিনশো অতিথি এসেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা কবিকে সংবর্ধনা জানান।
কালিম্পংয়ে থাকার সময় কবির সঙ্গে জেএ গ্রাহামের পরিচয় হয়। গ্রাহাম ১৯০০ সালে সেন্ট এন্ড্রুজ কলোনিয়াল হোম্স প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে পাঁচ মাইলের মতো পথ আসেন। ফিরে যান ঘোড়ায় চড়ে। ওই সময় প্রায় সাতশো আবাসিক ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন গ্রাহাম। কবির সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক দিন কবি তাঁর আশ্রমে যান। সেখানে বসে কবিতা লেখেন।
চলে এলো সেই পঁচিশে বৈশাখ। পাহাড়ি শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে এ বারও কবির জন্মদিন পালিত হবে। মংপু থেকে মনমোহন সেন, মৈত্রেয়ী দেবী ও চিত্রিতা দেবী এলেন। কলকাতা থেকে এলেন প্রবোধ সান্যাল। কবি টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন। জন্মদিন কবিতাটি আবৃত্তি করবেন। এ জন্য ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ এসেছেন। টেলিফোন বারবার পরীক্ষা হল। কবি গৌরীপুরের ঘরে বসে আছেন। জানালা, দরজা বন্ধ। বাইরে রেডিও নিয়ে প্রত্যেকে অপেক্ষা করছেন। কবির কণ্ঠস্বর ঘর থেকে সোজা কলকাতা এবং কলকাতা থেকে বাইরে অপেক্ষমানরা শুনবেন।
তখন সাড়ে ৭টা কী ৮টা হবে। কবির কন্ঠস্বর ভেসে এলো---‘আজ মম জন্মদিন। সদাই প্রাণের প্রান্ত পথে/ ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে/ মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।’ পনেরো মিনিট। শেষ হল কবির আবৃত্তি। কালিম্পং পাহাড়ে ফিরে এলো নির্জনতা। ‘জন্মদিন’ কবিতাটি ১৩৪৫ সালের ২৫ বৈশাখ গৌরীপুর ভবনে বসে লেখেন কবিগুরু। এখানে বসে আরও কয়েকটি কবিতা লেখেন তিনি।
কবিগুরু ১৯৪০-এর ২০ সেপ্টেম্বর ফের কালিম্পংয়ে যান। তাঁর সরাসরি মংপুতে যাওয়ার কথা ছিল। মৈত্রেয়ী দেবীকে কথা দিয়েছিলেন। প্রতিমা দেবী ৩ সপ্তাহ আগে কালিম্পংয়ে যান। গৌরীপুর ভরনের ঘরগুলি সযত্নে সাজিয়ে রাখেন। সে বার কবির অসুস্থ শরীর। চিকিৎসক নীলরতন সরকার ও বিধানচন্দ্র রায় কবিকে পাহাড়ে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কবি শোনেননি।
তখন কালিম্পংয়ে ভরা শরত। সোনা রং ফুলের সুবাসে মনোরম পরিবেশ। ভোরে কবি আরাম কেদারায় বসেছেন। ঘরের জানলা খোলা। তিনি কবিতা ও চিঠি লেখায় মগ্ন। তবে আনন্দের সময় যে শেষ হয়ে আসছে সেটা কারও অজানা ছিল না। সন্ধ্যা সমাগত। তাই ঘরে ফিরতেই হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর কবি অসুস্থ হন। ওই সময় ‘জন্মদিনে’ ১৪ সংখ্যক কবিতাটি শেষ রচনা করেন।
বিশ্বকবির মৃত্যুর পরে ‘চিত্রভানু’র দেওয়ালে মার্বেল পাথরে ওই কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাই করা হয়। তাঁর ছবি নীচে। মূল ছবিটি অবনীন্দ্রনাথের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.