প্রবেশ পথে ঢোকার মুখেই নজর টানে বাঁ দিকে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় শতাধিক বছরের পুরনো দু’টি গাছ। চারপাশে ঢেউ খেলানো পাহাড়। তারই কোলে যেন মেপে বসানো বাংলো বাড়িটি। দার্জিলিঙের জে বি থাপা রো-এর রোজভিলা। ১৮৮২-র অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ এ বাড়িতেই সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে গিয়েছিলেন।
বাড়িটির বর্তমান মালিক লাওয়াং ভুটিয়া জানালেন, তিন পুরুষ ধরে তাঁরা এই বাড়িতে বাস করছেন। ঠাকুর্দা সোনম তোপনে লামা প্রায়ই বলতেন রবীন্দ্রনাথের কথা। তাঁর মুখেই শোনা রবীন্দ্রনাথ কয়েক দিন এ বাড়িতে থেকেছিলেন। সে বারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরীর দার্জিলিং সফরের সঙ্গী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই তাঁর প্রথম দার্জিলিং যাত্রা। তাঁরা এসে উঠেছিলেন এই রোজ ভিলাতে। দার্জিলিং পাহাড়ে এসে কবি লিখলেন ‘প্রতিধ্বনি’।
একতলা বাড়ি, টিনের চাল। বাইরের দেওয়ালে ইটের গাঁথুনি। মেঝে ও ভিতরের দেওয়ালের অংশ কাঠের। বাড়িটির একাংশ সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাওয়াং ভুটিয়া বলেন, “অন্তত বছর ত্রিশ আগে ঠাকুর্দার সময় তিনি কিছুটা সংস্কার করেছিলেন। তারপর আর সম্ভব হয়নি।” |
মংপুতে মৈত্রেয়ীদেবীর বাড়ির কথা আমরা জানি। জানি কালিম্পংয়ের গৌরীপুর লজের কথাও। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গিয়েছে দার্জিলিং শহরের রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বেশ কয়েকটি বাড়ি।
সে রকমই একটি কাসলটন হাউস। জওপুর রোয়ের জনবহুল এলাকায় সাদামাটা দোচালা বাড়ি—দার্জিলিং সরকারি কলেজের লেডিজ হস্টেল। চারপাশে অসংখ্য ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সহজে চোখে পড়ে না। ১৮৮৭ সালের, অক্টোবরে দার্জিলিং যাত্রায় কবির সঙ্গী ছিলেন মৃণালিনীদেবী, বড়দিদি সৌদামিনী, ন’দিদি স্বর্ণকুমারী, তাঁর দুই কন্যা হিরন্ময়ী ও সরলা। বেলা তখন একরত্তি। তাঁরা সদলে উঠলেন কাসলটন হাউসে। স্বর্ণকুমারী দেবীর বর্ণনায়, “এ বাড়ির একটি নাম আছে খুব মস্ত। লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের বাড়ি ছাড়া দার্জিলিঙে শুনতে পাই এত বড় বাড়ি আর নেই। সেই জন্য এর নাম হচ্ছে ক্যাসলটন হাউস।” |
সেই বাড়ির হলঘরটিতে কবি পড়ে শোনাতেন টেনিসন, ব্রাউনিং। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বউদের দ্বিজেন্দ্রলাল ও অরুণেন্দ্রনাথের হেফাজতে রেখে ফিরে গেলেন এক মাস পর। একাই।
কলেজের অধ্যক্ষা ললিতা রাই আহমেদ বলেন, “অনেকের মুখেই শুনেছি রবীন্দ্রনাথ এ বাড়িতে ছিলেন। ২০০৬ সালে আমি অফিসার ইন চার্জ থাকাকালীন বাড়িটি একবার সংস্কার করা হয়। বর্তমানে গোটা ভবনটিরই সংস্কারের প্রয়োজন। পূর্ত দফতরের নির্মাণ পর্ষদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। তারা সংস্কার বাবদ হিসেবের খরচ দিয়েছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যেই সংস্কারের কাজ শুরু করতে পারব।” উত্তরবঙ্গ নির্মাণ পর্ষদ ডিভিসন-২ এর কার্যনির্বাহী বাস্ত্ুকার সৌম্য হাইত বলেন, “কাসলটন হাউসের সংস্কারের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি।”
আদতে নাম ছিল তার আসানটুলি। বর্তমানে ওয়েস্ট বেঙ্গল লেবার ওয়েলফেয়ার বোর্ড ওয়ার্কার্স-এর হলিডে হোম। ১৯৩১-র মে মাসের শেষ দিকে কবি দার্জিলিঙের এলেন হাওয়া বদল করতে। জুলাইয়ের প্রায় প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁর ঠিকানা হয়ে উঠল আসানটুলি। দার্জিলিঙের এ জে সি বোস রোড ধরে যেতে ডান দিকে নীচে পাহাড়তলিতে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য সেই বাড়ি। তৎকালীন দার্জিলিঙের মহারানি গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের কলমে সে বাড়ির বর্ণনা, “লাল করগেটের ছাদ। একতলা লম্বা বাড়ি, সারি সারি কাচের জানালা। খানিকটা কাঁকর বাঁধানো জমি। ফুলে ফুলে রঙিন।” |
আট দশক পরেও বাড়িটির রূপ বদলায়নি বিশেষ। সে বারে দার্জিলিং বাসের দিনগুলিতে কবির সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, নাতনি পুপে (নন্দিনী)। এসেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও রানি মহলানবিশও। এ বাড়িতে বসে কখনও লিখেছেন ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধ। কখনও বিচিত্রা পত্রিকার জন্য নতুন করে লিখতে বসেছেন ‘রাজা’ নাটক ‘সুদর্শনা’ নামে।
উত্তরবঙ্গের কার্যনির্বাহী বাস্তুকার সৌম্য হাইত বলেন, “বছর তিনেক আগে বাড়িটির সংস্কারের জন্য লেবার ওয়েলফেয়ার দফতর থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়। এ বছর মার্চে পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ মিলেছে। সংস্কার শুরু হয়েছে। সব কিছুরই সংস্কার প্রয়োজন।” অনেকে বলেন, আগেই এই কাজ করা দরকার ছিল। কারণ দেরি হলে ভবনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি ফেরানো সম্ভব হয় না।
জীবনের উপান্তে এসে কবি নিভৃত বিশ্রামের জন্য বেছে নিলেন কালিম্পং শৈলাবাস। গৌরীপুর ভবন আজ পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। কালিম্পংয়ের মিলনী ক্লাবের সভাপতি অধ্যাপক মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “কালিম্পংয়ের কতিপয় ব্যবসায়ী বাড়িটিকে হোটেল করার উপক্রম করেছিল। আমরা জানতে পেরে ক্লাবের এবং নাগরিক সমাজের উদ্যোগে বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাই। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাড়িটি রাজ্য কো-অপারেটিভ বিভাগ ৯৯ বছরের জন্য বাড়িটি লিজ নেয়। এক সময় এখানে ট্রেনিং ক্লাসও হত। সে সব বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় পঁচিশ বছর হল।” ১৯৩৮ সালে কবির ৭৮তম জন্মোৎসব পালিত হয়েছিল এই গৌরীপুর ভবনে। দ্বিতীয়বার আসেন ১৯৪০-এর জুনে। অসুস্থ, বয়সের ভারে অশক্ত শরীর। জেদ করেই কালিম্পং-এ চলে এলেন সেপ্টেম্বরে। গৌরীপুর ভবনে প্রবাস যাপনকালে কবি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাঁকে দ্রুত পাহাড় থেকে নীচে নামিয়ে আনতে হয়। গৌরীপুর ভবন হয়ে রইল তাঁর শেষ অবসরের ঠিকানা। |