দিন তিনেকের বাসি কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। ছায়াছন্ন জঙ্গল। শুকনো পাতা মাড়ানোর মৃদু শব্দ। আর ওঁরা ক-জন।
দক্ষিণ বাঁকুড়ার বাগডুবির বন, পুরুলিয়ার নিবিড় অযোধ্যা কিংবা লাটাগুড়ির অন্তহীন তরাই গত কয়েক দিন ওঁদেরই দখলে। পুরনো ন্যাতা জড়ানো শিঙা ফুঁকে ওঁরা বলছেন, ‘শিকারে হবে যেতে আয় রে সাথে...’ কোমরে গোঁজা ধারাল চোপা (ছুরি) আর বড়জোর শাল কাঠের পোক্ত একটা ডাল। অস্ত্র বলতে এটুকুই।
বাকি ভরসাটা ওঁরা ছেড়ে দিয়েছেন রানি, কুসমা, রুহির মতো কয়েক জনের উপরে। কেউ নিকষ কালো, কেউ মেটে লাল, কারও আবার সাদা-লালচে ছোপ। সময়ের সঙ্গে তির-ধনুক, বল্লম ধার হারিয়েছে। এখন শুধু পাক্কা আইরিশ ‘ডাক-হান্টারদের’ মতো নানা রঙা কুকুর-কুলই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে আদিবাসী শিকারের সঙ্গে।
বাঁকুড়ার বারিকুলের সাগিন সোরেন বলেন, “বছর পাঁচ-সাত আগেও শিকারে যাওয়ার সময়ে ওই তির-ধনুকই ছিল ভরসা। এখন কিন্তু ভরসার নাম বদলে গিয়েছে তারা রুহি বা কুসমা।” খরগোশ থেকে খটাস, এমনকী ধারালো দাঁতের বন শুয়োর ঘায়েল করে শিকারের প্রথম পর্বটা ওরাই সেরে রাখছে। |
অযোধ্যার ‘শিকারি’ রতন মুর্মু বলেন, “আগের মতো আমরা এখন বল্লম-সড়কির উপরে তত ভরসা করি না, যতটা করি ওই শিকারি কুকুরদের উপরে।” জঙ্গল দাপিয়ে শিকারে বের হওয়ার সময়ে ওই সারমেয়কুল কিন্তু দড়িতে বাঁধা বাধ্য, পাশে-পাশে হাঁটা নিতান্তই এক ছাপোষা প্রাণী। ভুলটা ভাঙে শিকার দেখা মাত্র গলার বাঁধন আলগা হওয়ার পরে।
বারিকুলের স্বপন টুডু জানান, দড়ি খুলে দিলেই কুকুরেরা তীব্র বেগে শিকারের পিছু ধাওয়া করতে থাকে। তাঁর কথায়, “ওরা ঠিক জানে, শিকার কোনটা। দল বেঁধে খরগোশ বা খটাসের পিছনে দেড় কিলোমিটারও ধাওয়া করে ওরা। তার পরে নির্ভুল কামড়ে ঘাড়ের কাছটা ধরে ঝুলিয়ে আনে শিকার। তবে প্রভুর কাছে নিয়ে না-আসা পর্যন্ত শিকার থেকে এক টুকরো মাংসও ওরা ছোঁবে না।”
আসলে দিশি কুকুরগুলিকে তৈরি করাই হয় এ ভাবে। সাগিন জানান, শীতকালে গ্রামের দিশি কুকুরের ছানাপোনা জন্মায়। তাঁরা তক্কে-তক্কে থাকেন। শক্তপোক্ত শাবক দেখলেই তাকে আলাদা করে দুধে-ভাতে বড় করে তোলেন। মাস চারেক বয়স হলে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। বকে-ধমকে, কখনও বা চপেটাঘাতে মাস তিনেকের মধ্যেই তারা হয়ে ওঠে পাক্কা শিকারি। সাগিন বলেন, “ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলে তখন এক শিসেই কাজ হয়।”
কৃষ্ণপক্ষের রাতে উড়ছে সেই শিস আর শুকনো পাতা মাড়ানো জঙ্গল ভাঙা দৌড়। |