প্রবন্ধ ১...
হে নূতন: অন্ধকারের উৎস হতে
যে নূতনকে ডাক দিল পঁচিশে বৈশাখ তা ব্ল্যাকবেরি বা থ্রি-জি ফোনের মতো দু’চার বছরের জন্য নূতন নয়। চির-নূতন। রবি ঠাকুর কি বড়াই করে বলছেন, ‘আমার জন্মদিনে যে নূতন আসবে তা কখনও পুরনো হবে না’? রবীন্দ্রনাথ আত্মগুণমুগ্ধতার অসুখে ভুগতেন এ কথা নেহাত গত পরশু ‘নার্সিসিজম’ শব্দটা শিখে মহাগুরুনিপাতনে সিদ্ধ হওয়ার জন্য চুলবুলিয়ে উঠেছে এহেন আকাট ছাড়া কেউ বলবে না। অথচ এ কথা অনস্বীকার্য যে তিনি নিজের জন্মদিনকে বেশ সিরিয়াসলি নিতেন। যেমন নিতেন নিজের নামকে। প্রথম দিনের আর দিবসের প্রশ্ন উচ্চারক সূর্য যে ‘রবি’ নামধারী প্রতি বছরের ‘নবজাতক’টিই, তা যেমন জলের মতো পরিষ্কার, তেমনই পরিষ্কার এটাও যে এই সূর্যের চোখধাঁধানো প্রখর দীপ্তির গর্ভে একটা গভীর অতৃপ্তি ও দুঃখবোধের জমাট অন্ধকার থেকেই গিয়েছিল। নিজের ব্যক্তিগত ‘আমি’কে নিয়ে তাঁর যে কত কবিতা কত গান, তা শঙ্খ ঘোষ রণজিৎ গুহ এঁরা গভীর সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বল্পপরিচিত ‘অপূর্ণ’ কবিতাটিতে, আমার তো মনে হয়, তিনি নিজেকেই ‘তুমি’ বলে ডেকেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি’ মানেই জীবনদেবতা, এই বুড়ো আঙুলের নিয়ম এখানে খাটে না।
‘জন্মদিন মৃত্যুদিন, মাঝে তারি ভরি প্রাণভূমি
কে গো তুমি’।
‘ফাল্গুনী’তে রবীন্দ্রনাথ। শিল্পী: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দেবতার জন্ম যদি বা হয়, যার বাচক শব্দ ‘অমর’, তারই মৃত্যুদিন কল্পনা করাটা নীচ্চের পক্ষে সমীচীন হলেও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে নয়। ‘অপূর্ণ’ কবিতার শুরুতে নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করানোর আগে বৃহদারণ্যক উপনিষদে যেমন ‘মৃত্যুই এর আত্মা, অশনায়া মানে ক্ষুধাই হল মৃত্যু’ বলে শুরু হচ্ছে তেমনই কবি ইন্দ্রিয়ের, শরীরের, মনের ক্ষুধার কথা দিয়ে সাদা ও কালো (ভাল ও মন্দ?) বস্তু ও ছায়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই তুমি-আত্মার মূর্তি। এই তুমি অতীত আর এখন নিয়ে খুশি নয়। তার যা ছিল তা সকল গেল যা নেই তার খোঁজে। আর এই চির অতৃপ্তি থেকেই তো আসছে নূতনের অপেক্ষা। অন্য কিছু হবে। কী জানি কী হবে? অজানার জয় হোক। আরও মাটির কাছাকাছি কবিরা আসবে তার জন্য কান পেতে আছি। সভ্যতার সংকট কেটে যাবে। যা কেটে যায় তাকেই তো সংকট বলে। এতটা যখন বুক-ফাটানো ধ্বংস হচ্ছে ভেতরে-বাইরে, কৃষ্টিতে-সৃষ্টিতে, সমাজে-শরীরে, এর পরেও ‘উৎস যদি না বাহিরায় হবে কেমনতরো?’ সকল দ্বন্দ্ববিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভাল তা এখন দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু আসবে। সেই নূতন, সেই ঝড়ের রাতে দুয়ারভাঙা নূতন আসবে। ‘জন্মদিনে’ বইয়ের একটি কবিতায় বিদ্রূপতিক্ত নিরাশার মধ্যে হঠাৎ ওই অনাগতের অভ্যর্থনা দেখি:
‘দামামা ওই বাজে
দিনবদলের পালা এল ঝোড়ো যুগের মাঝে
অন্যায়েরে টেনে আনে অন্যায়েরি ভূত, ভবিষ্যতের দূত।’
(জন্মদিনে, ১৬ নং কবিতা)।
তা হলে জন্মের প্রথম শুভক্ষণের চিন্তার মধ্যে জড়িয়ে আছে তিনটি রবিসাধা সুর: অপূর্ণতা, ভবিষ্যৎকাল আর নূতনের পিপাসা।
গত বছরের শেষ দিকে, এই কাগজেরই পৃষ্ঠাতে অতীতের সত্তা অ-সত্তা নিয়ে একটু লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। (‘ভূত-ভবিষ্যতের দর্শন...’, ২৭-১২) কিন্তু বিগত আর অনাগত এই দুই হাতেই তো কালের মন্দিরা বাজে। তাই ভবিষ্যৎমন্দিরাটি নিয়ে, এই পঁচিশে বৈশাখে, লিখতে বসেছি।

‘নূতন’ মানে হল, যা আগে কখনও হয়নি বা ছিল না, সবে এইমাত্র জন্মাল। কিন্তু যা একেবারেই নেই, যেমন বালি থেকে বের করা তেল, তা হবে কী করে? ভারতবর্ষের প্রাচীনতম দার্শনিক কবিতা, যার নাম ‘নাসদীয় সূক্ত’, তো এই সমস্যা নিয়েই মাথা ঘামিয়ে শেষ পর্যন্ত বলেছে কেউ জানে না কী করে, কোথা থেকে, এই বিসৃষ্টি আবির্ভূত হল। এই সমস্যাটা নিয়েই তো ভারতীয় দর্শনে দুটো বিবদমান দল তৈরি হয়েছে। এক দল বলেন, যা নতুন বলে মনে হয়, যেমন একখানা বীজ থেকে জন্মানো বটগাছ, সেটা আগে থেকেই তার কারণরূপী বীজটার মধ্যে লুকিয়ে ছিল। এর নাম ‘সৎকার্যবাদ’। এঁদের বিপক্ষে রয়েছেন বাস্তববাদী সেই সব দার্শনিক যাঁরা বলেন, পরিষ্কার চোখের সামনে দেখছি বীজ আর গাছ আলাদা জিনিস, বীজের ছায়ায় বসে জিরোনো যায় না, গাছের ছায়ার নীচে বসে জিরোনো যায়। একতাল মাটিতে করে জল আনা যায় না কিন্তু সেই মাটি দিয়ে তৈরি ঠিকমত পোড়ানো কলসিতে করে জল আনা, রাখা যায়। কাজেই কারণের অতিরিক্ত কার্য একটা নতুন জিনিস। এর নাম ‘আরম্ভবাদ’।
এক তৃতীয় দল দার্শনিক দু’পক্ষের কথাতে সায় দিয়ে বলেছেন, আসলে ওই যে অভিজ্ঞতাসিদ্ধ নূতনত্বটা যেটা কেকের মধ্যে আছে কিন্তু দুধ-ময়দা-চিনি-ডিমের মধ্যে নেই সেটা আগে ছিল এটাও ঠিক নয় আর আগে ছিল না এটাও ঠিক নয়। জাদুকর যেমন ফাঁকা হাতের মুঠো থেকে পনেরোটা পায়রা বের করে দেখায়, প্রকৃতির মধ্যে নতুন জিনিসের আবির্ভাবও সেই রকম। দেখতে যখন পাচ্ছি তখন একেবারে নেই বলতে পারি না। কিন্তু আগে যদি না থেকে থাকে, ‘নেই’ থেকে তো ‘আছে’ আসতে পারে না তাই আছেও বলতে পারি না। এমনই জিনিসকে বলে সৎও নয় অসৎও নয় অনির্বচনীয়। ইংরেজি ম্যাজিকের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হল মায়া। নতুন বিষয়ে এই তৃতীয় মতের নামও তাই ‘মায়াবাদ’।
বর্তমান বা অতীত সমাজসংসারে যা কিছু আছে যে রকম ব্যাপারস্যাপার চলছে তাতে যে বিপ্লবীরা খুশি নন তাঁরাও একটা নূতন সমাজ আনতে চান। যা কোনও দিন হয়নি ক্ষমতা বা সম্পদের সমবণ্টন, মানুষে মানুষে ঈর্ষার নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বের অবসান, বকুনি-কান্নামুক্ত শৈশব, ব্যর্থ উন্মাদ উদগ্র অবুঝ আকাঙ্ক্ষার জ্বালাহীন যৌবন, উপেক্ষার হিমশৈত্য থেকে সুরক্ষিত সাদর বার্ধক্য এই সব যা কখনও ছিল না, হয়নি, তা ভবিষ্যতে আসবে এই স্বপ্ন যাঁরা দেখেন তাঁরা কিন্তু ওই আগামী ভুবনকে মায়া বলতে রাজি নন। পরিবর্তনশীল এই জগৎটাকে কেবল ব্যাখ্যা করেছেন সৎকার্যবাদী, অসৎকার্যবাদী, মায়া বা বিবর্তনবাদী দার্শনিকরা। সকল দ্বন্দ্ববিরোধের অন্ধকার থেকেই আসবে আর একটু ন্যায্যতর অ-বিষম পাল্টানো জগৎ, এ কথা যে কর্মোদ্যোগী বিপ্লবীরা বলেন তাঁরা জগৎটাকে শুধু ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করে খুশি নন। তাঁরা কর্ণের মতো পুরুষকারে বিশ্বাসী, হাস্যমুখে অদৃষ্টকে পরিহাস করে তাঁরা যুগে যুগে লড়েই যাবেন, যতই না যুগান্তের অস্তবেলায় একচ্ছত্র ক্ষমতামদমত্ততার কর্দমে তাঁদের বিপ্লবের রথের চাকা বসে যাক। ভবিষ্যৎটা অতীতেরই মতো হবে এই থিয়োরি মানলে রানারের হাতে চিঠি পাঠানোর যুগ থেকে ক্ষণিকের অব্যবধানে বহু হাজার মাইল দূরে থেকে স্কাইপে যুগপৎ দেখা-শোনার যুগে এসে পৌঁছনো যেত না।
এমন করাল রোগ, এমন পরমাণু ফাটানো বিষের ধোঁয়াও এনে দিয়েছে মানুষের বুদ্ধিবাণিজ্যের শয়তান যা পাঁচ দশ হাজার বছর ধরে হিংস্রতম মানুষও ভাবতে পারেনি সম্ভব বলে। আসুরী সম্পদে যদি এমন সব কল্পনাতীত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে তা হলে দৈবী সম্পদেও ব্রেখ্ট-এর ‘ভালমানুষ’-এর মতো ভাবতে ক্ষতি কী যে এই প্রলয়নাচনে মত্ত রুদ্রেরই প্রসাদে
‘একদিন আস্বে,
ফুটপাথ থেকে ভিখিরির ছেলেটা
মখমলে মোড়া বেদীর ওপর সিংহাসনে বস্বে
... দুনিয়ায় শুধু ভালো থাকবে, মন্দ কিছুই থাকবে না
জ্ঞানীর গুণীর কদর হবে..., ভাতের অভাব, অভাব শুন্লেই
লোকে হো হো হাস্বে
‘শোষণ’ ‘শাসন’ শব্দ শুন্লেই
লোকে হো হো হাস্বে
সেই অদ্ভুত দিনও, স্বপ্নের দিনও, গল্পের দিনও আস্বে’।

দেখা যাক এই ভবিষ্যৎ ব্যাপারটাকে অ-বাস্তব, অলীক বলে নিরাশার নস্যিঠাসা উচ্চনাসা পণ্ডিতরা কেন খণ্ডন করে উড়িয়ে দেন।

ভবিষ্যতের কোনও সত্তা নেই, তা বন্ধ্যাপুত্রের মতোই অবাস্তব এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে নিম্নলিখিত যুক্তি দিয়েছেন সি ডি ব্রড নামে কেমব্রিজের বিশ শতকের গোড়ার দিককার এক জন দার্শনিক। একটা ঘটনার পরবর্তী ঘটনাকে তার ‘সন্তান’ বলা যাক। তা হলে ভবিষ্যতের ডেফিনিশন হল: সেই ঘটনা বা ঘটনাবলি যা বর্তমান মুহূর্তটার সন্তান বা উত্তরবর্তী। অথচ বর্তমান মুহূর্তের ডেফিনিশন হল: সেই সময় বা ঘটনা যার কোনও সন্তান বা উত্তরবর্তী নেই। ‘এখন’ তো তাকেই বলে। তা হলে দুটো ডেফিনিশন থেকে আমরা পাচ্ছি: ভবিষ্যৎ হল নিঃসন্তান নিরুত্তর ক্ষণের উত্তরসন্তান। এই অন্তর্বিরোধগর্ভিত ধারণাটি যে ঘোড়ার ডিমের মতোই অলীক হবে তা তো অকাট্য বলে মনে হচ্ছে।
এই যুক্তিটাতে আসলে কোথায় ফাঁকি তা ধরতে পারা শক্ত, তার কারণ একদিক থেকে ভাবলে সত্যিই তো ভবিষ্যৎ তাকেই বলে, যা ঘটেনি, আসেনি, যার আসার আগেকার অবস্থা যাকে বলে প্রাক্-অভাব তা-ই এখনও চলছে। বহমান কালস্রোতের ঘটিত অতীত আর ঘটমান ইদানীংকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তারই তো নাম ‘অনাগত’ কাল। বিশ শতকের শেষের দিকে তাই আমার অমায়িক সূক্ষ্মবুদ্ধি মাস্টারমশাই স্যর পিটার স্ট্রসন ‘ভবিষ্যৎ-নাস্তিক’কে উদ্দেশ্য করে বেশ মজা করে লিখেছিলেন: ‘‘হয় তুমি বলতে চাইছ যে আমরা ইতিহাসের অন্তিম মুহূর্তে বাস করছি, এর পর ব্রহ্মাণ্ডে আর কিচ্ছু ঘটবেই না যে বক্তব্যটা বেশ নাটকীয় কিন্তু তুমিও আসলে তাতে বিশ্বাস করো না; অথবা তুমি বলতে চাইছ যে যা ঘটবে তা এখনও ঘটেনি যে বক্তব্যটা এতই স্বতঃসিদ্ধ যে সকলেই মানে, জানে। এ ছাড়া ‘ভবিষ্যৎ নেই’ তোমার এ কথার যেহেতু তৃতীয় কোনও সংগত ইন্টারেস্টিং অর্থই হয় না, আগামী বারে যখন তুমি কিছু প্রমাণ করতে চাইবে আর একটু সাবধানে অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কথা বোলো।’’ ফিউচার-অপলাপকারীকে আগামী বারে সুযোগ দেওয়ার মিছরির ছুরিটা বুঝলেন তো?

রবীন্দ্রদর্শনের মূল তত্ত্ব হল মানুষর উপচে-পড়া উদ্বৃত্ত, ‘দ্য সারপ্লাস ইন ম্যান’। এটা যখন আমরা ভাবি তখন যেন এর ঠিক বিপরীত দিকটার কথা ভুলে না যাই। মানুষের অপূর্ণতা, অ-সমাপ্তি, অতৃপ্তির আকুতির দিকটাও রবীন্দ্রনাথের কাছে সমান জরুরি। তা হলে আমার, আমাদের, মানুষের এই চির-ঘাটতির বোধটাই কি তার অতিবর্তিতার, তার নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার অভিজ্ঞান? এ কী রকম কমতি, যাতে বাড়তি উথলে ওঠে?
একটা অসম্পূর্ণ ‘খণ্ডিত এ অস্তিত্বের ব্যথা’ নিয়ে উদ্দেশ্যহীন অজানার জন্য ক্ষুধাতুর, আরও আরও আরও দাও প্রাণ বলে বাঁচতে বাঁচতে, মরতে মরতে, আমি/তুমি নিজের সঙ্গে নিজে ঝগড়া করতে করতে বয়ে চলেছে। ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের অনবদ্য ‘অপূর্ণ’ কবিতাটির শেষে ‘একদিন আসবেই’ এই আশ্বাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ একটাই যুক্তি দিয়েছেন। (আমার বাবা একটি গানে এই যুক্তিকেই সহজ ভাবে প্রকাশ করেছিলেন ‘এ কী হতে পারে, ক্ষুধা আছে সুধা নাই?’)
‘অপূর্ণতা আপনার বেদনায়
পূর্ণের আশ্বাস যদি নাহি পায়, তবে রাত্রিদিন হেন
আপনার সাথে তার এত দ্বন্দ্ব কেন? ক্ষুদ্রবীজ মৃত্তিকার সাথে যুঝি
অঙ্কুরি উঠিতে চায় আলোকের মাঝে মুক্তি খুঁজি॥’

এটা মোটেই কোনও আরোহ বা অবরোহ অনুমিতি নয়, কোনও বৈজ্ঞানিক লজিক এতে নেই। এ হল, মহামতি ইমানুয়েল কান্টের ভাষায় ‘আমরা যা আশা না করে পারি না’ সেই ভবিষ্যৎমুখী নৈতিক বিশ্বাস (মরাল সাটর্ন্টি)। সকল দ্বন্দ্বের অন্ধকারের উৎস থেকে ভালর আলো উৎসারিত হবেই হবে। সেই স্বপ্নের দিনও, গল্পের দিনও আসবে। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামে একটা সাত পৃষ্ঠার দীর্ঘ কবিতায় অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন জীবনক্লান্ত ছুটি-চাওয়া বিশ্বকবি,
‘পঁচিশে বৈশাখ চলেছে জন্মদিনের ধারাকে বহন করে মৃত্যুদিনের দিকে
সেই চলতি আসনের উপর বসে
কোন কারিগর গাঁথছে ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায়
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।’


বেহাগ বোধহয় তাঁর সব থেকে প্রিয় রাগ ছিল। ‘চিরসখা হে’ থেকে ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে’ পর্যন্ত যেমন এই রাগে তিনি বেঁধেছেন, তেমনি এক আশ্চর্য চিরনূতন গান তিনি আমাদের কানে না-বোঝা মন্ত্রের মতন অর্পণ করে গেছেন। এখনও মেঘে ঢাকা রাত কাটেনি। কিন্তু মেঘ কথা দিয়েছে ‘যাবো যাবো’ রাত বলেছে ‘যাই’। অন্যায়, বৈষম্য, নিষ্ঠুরতার বাত্যাবিক্ষুব্ধ সাগরও বলেছে, ‘আর দেরি নেই কূল মিলেছে তটভূমি দেখা যাচ্ছে’ দিন আগত ওই। যে দুঃখের আগুন জ্বেলে সকল কলুষতামসরাশি ছাই করে ফেলে নতুন সৃষ্টির অঙ্কুর উদ্ভিন্ন হয়েছে সেই দুঃখ বলছে ঈশ্বরের পদচিহ্ন রূপে আমি রইনু চুপে। ভুবন বরণমালা নিয়ে সেই শিশুতীর্থে অপেক্ষা করছে। গগন তার জন্য লক্ষ তারার প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতীক্ষমাণ। ভালবাসা তো যুগে যুগে ওই আমি-তুমি-তাহার লাগি নিদ্রাহারা জেগেই থাকবে। কিন্তু সবার থেকে রহস্যময় হল সেই শ্যামসমান মেঘবরণ নৌকা চালক। গণেশ পাইনের সাবলীল কাটাকুটির অন্ধকার থেকে মরণের সেই ছায়ামূর্তি তারসপ্তকের মধ্যম ছুঁয়ে এসে বলছে ‘আমি তোমার জীবনতরী বাই।’

‘জন্মদিন’ কাব্যগ্রন্থেই লিঙ্গ-ভিত্তিক ‘অবিচার’-এর বিরুদ্ধে একটি ফেমিনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মতো সংযোজনে রবীন্দ্রনাথ সমস্ত পুরুষ জাতিকে কলঙ্কিত কাপুরুষ বলে সাব্যস্ত করে কপাল চাপড়েছেন যে,
‘সম-সম্মান হেথা নাহি মানে পুরুষে
নিজ প্রভুপদমদে তুলে রয় ভুরু সে।
...বুঝিতে পারে না ওরা এ বিধানে ক্ষতি কার,
জানি না কী বিপ্লবে হবে এর প্রতিকার,
একদা পুরুষ যদি পাপের বিরুদ্ধে,
দাঁড়ায়ে নারীর পাশে নাহি নামে যুদ্ধে
অর্ধেক কালিমাখা সমাজের বুকটা
খাবে তবে বারে বারে শনির চাবুকটা।’

কিছু দিন আগে দিল্লির গণধর্ষিতা মেয়েটির মৃত্যুতে যে বিশ্বব্যাপী কলঙ্ককাহিনি ও ভারতব্যাপী প্রতিবাদের বিপুল তরঙ্গ উঠেছে, তা ওই ‘শনির চাবুক’ বলেই মনে হয়।
এই হানাহানির দুঃসময়ে সমাজদার্শনিক হানা আরেন্ট-এর কথা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ না পড়েও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নারকীয় নৃশংসতার মধ্যে পাপাচারের প্রাত্যহিকতা, মহামন্দের মামুলিপনার তত্ত্ব বোঝাতে বোঝাতেও বিশ শতকের এই নির্ভয়া গার্গী লিখেছিলেন (দ্য হিউম্যান কন্ডিশান, পৃ. ২৪৭): শেষ পর্যন্ত ‘যে অলৌকিক/ মির্যাক্ল/ জগৎকে বাঁচায়, মানুষের নৈসর্গিক ‘প্রাকৃতিক’ বিনষ্টি থেকে তা হল জন্মশীলতার ঘটনা। নতুন মানবের জন্ম। নতুন প্রারম্ভ। যেমন গস্পেলস আমাদের সুসমাচার দিয়েছে, ‘আমাদের মধ্যে একটি শিশুর জন্ম হয়েছে।’ পঁচিশে বৈশাখ সেই জন্মের শুভক্ষণের দিকে, প্রতি বছর আমাদের এক অসম্ভব অনাগতের আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায়।
এই নবজন্মের তীরে উত্তরণের নৌযাত্রায় আমাদের একমাত্র মাঝি হচ্ছে আমাদের অহংয়ের মরণ। তাই মেঘ যখন বলেছে ‘যাবো যাবো’ তখন ‘আমি বলে মিলাই আমি, আর কিছু না চাই’।
একদিন তাঁর এ আমির আবরণ যখন খসে গিয়েছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘মনে মনে তর্ক করি আমিশূন্য আমি। সব থেকে কার লাগি বাজিল বেদনা? সে আমার ভবিষ্যৎ।’ কর্কশ বিতর্কে, আত্মসমালোচনার চাবুকে, ইতিহাস মন্থন করে তুলে আনা, আশার অমৃত মেশানো সামূহিক সর্বনাশের হলাহল পান করে এই অসম্পূর্ণ আমি/তুমি কাকে পাবে?
‘সে আমার ভবিষ্যৎ
যারে কোনো কালে পাই নাই... ভূমিগর্ভে বীজের মতন
অঙ্কুরিত আশা লয়ে দীর্ঘরাত্রি স্বপ্ন দেখেছিল অনাগত আলোকের লাগি।’

(রোগশয্যায়)
সেই ভবিষ্যতে অন্তত সবাই খেতে পাবে। তুলোচাষিরা শয়ে শয়ে গলায় দড়ি দেবে না। দিনে লক্ষ টাকা ওড়ানো আর পাশাপাশি পঁয়ত্রিশ টাকাও রোজগার না করতে পারার অশ্লীল অসাম্যের অতীত কাহিনি শুনে সে দিনের নবজাতকরা হো-হো হাসবে।

পাদটীকা: রবীন্দ্ররচনাবলি থেকে ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের ‘অপূর্ণ’ কবিতাটি আর নান্দীকারের গানটি আমাকে জুগিয়েছেন সহপাঠী বন্ধুবর অশোক মুখোপাধ্যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.