এই বার পঁচিশে বৈশাখ যে মালাটি পরিবেন রবি ঠাকুর, তাহা অর্জন করিতে কবিকে বিস্তর পথ হাঁটিতে হইল। প্রমাণ করিতে হইল, বাঙালি জাতির আগাপাশতলায় নিজ প্রভাব তিনি এত দিন অটুুট রাখিতে সমর্থ। তিনি যে ‘বুর্জোয়া’ নহেন, অন্তত কেবলই ‘বুর্জোয়া’ নহেন, সেই লড়াই লড়িতে হইল। পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ১৪২০ বঙ্গাব্দে কবির জন্মদিনে তাঁহার প্রতিকৃতিতে মালা দিবে। অর্থাৎ বিদেশিদের নিকট তেরো সংখ্যাটি কুলক্ষণা হইলেও রবীন্দ্র-সংস্কৃতিতে ইহা শুভসূচক। উনিশশো তেরোয় আসিয়াছিল বিশ্বসেরা সাহিত্য পুরস্কার। দুই হাজার তেরোয় আসিল সি পি আই এম সম্মান! দ্বিতীয়টি কোনও অর্থেই হেয় নহে, কমিউনিস্ট পার্টির বিষম গুরুতর আত্মবীক্ষণ প্রক্রিয়া হইতেই তাহার উৎসারণ।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এই গুরুতর আত্মসচেতনতা এবং তদুপযোগী সুগম্ভীর সাংস্কৃতিক বিবেচনা যখন শিখর স্পর্শ করে, সেই উনিশশো চল্লিশের দশকের শেষে ভবানী সেন সুবিখ্যাত প্রবন্ধটি লেখেন, যাহাতে ঘোষিত হয় রবীন্দ্রনাথ এক জন পুরাদস্তুর ‘বুর্জোয়া’ সাহিত্যিক, তাঁহার রচনা বিপথদিশারী, ‘আবর্জনা’য় নিক্ষেপযোগ্য। বাস্তবিক, কমিউনিস্ট রবীন্দ্র-বীক্ষার এই ধারাটি এই প্রবন্ধেরই দান! তৎপরে গোপাল হালদার, সুশোভন সরকার প্রমুখ চিন্তকরা রবীন্দ্র-সাহিত্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করিয়াছেন, কিন্তু তদ্দ্বারা কমিউনিস্ট-রবীন্দ্রবিরোধিতার ধারাটির পরিবর্তন হয় নাই। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়-স্তর হইতে ‘সহজ পাঠ’ উঠাইয়া দিবার সময়ও বিপ্লবী মতাদর্শের সহিত রবীন্দ্ররচনার ‘জমিদারি’ সংস্কৃতির দূরত্বের দোহাই দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। ২০১১ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিলাপ শোনা গিয়াছিল, হায়, দলের ‘বামন’-সুলভ নেতাদের দৌলতেই দলে রবীন্দ্র-হেনস্তার এই রমরমা। তবে গণতন্ত্রচারী ভূমিতে বিপ্লবী মতাদর্শই তো শেষ কথা নয়, সবার উপরে আছে ভোটের বালাই। তাই বড় নেতারা যাহাই বলুন না কেন, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষেও চুপচাপ নানা অনুষ্ঠানে মাতিয়া উঠেন ছোট নেতারা। ১৯৭৭-পরবর্তী বাংলায় পাড়াতুতো কমিটিগুলি (র)বীন্দ্র-(সু)কান্ত-(ন)জরুল সন্ধ্যার আয়োজন শুরু করে। দুর্জনে বলিয়া থাকেন, বাম প্রতিপত্তি-সূর্য মধ্যগগনে থাকিবার সময় এমন স্লোগানও নাকি বাঙালি শুনিয়াছে, ‘রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি করল কে/ সি পি এম, আবার কে!’ ২০১৩ সালের এই মালাপ্রদানের সিদ্ধান্তের পশ্চাতেও যে প্রতিপক্ষ শাসক দলের রবীন্দ্র-বন্দনার হিড়িকই প্রধান কারণ, তাহা বলিয়া দিতে হয় না। স্পষ্টতই, রবীন্দ্র-প্রতিকৃতিকে ফুলমালার ডোরে বরিয়া লইবার এই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত আসলে রবীন্দ্রনাথের পুনর্মূল্যায়ন নহে, নিজেদের ম্রিয়মাণ জনগণ-ভিত্তিটিরই পুনর্মূল্যায়ন। অনেক দিনের অবজ্ঞা ও অনবধানের সংশোধন। দলের নেতৃ-অঙ্গের সহিত গণ-অঙ্গের পুনর্যোজন। ফাঁকতালে একটি অতিরিক্ত মালা পাইয়া গেলেন কবিবর। |