দুই দিন বাকি থাকিতেই পঞ্চদশ লোকসভার চতুর্থ বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বের উপর আকস্মিক যবনিকা পতন। ইহার পরিণাম: রেলওয়ে বাজেট ও অর্থ বিল পাশ হওয়া ছাড়া এই সমগ্র অধিবেশনে সংসদের আর কোনও কাজই হইতে পারে নাই। অথচ এই অধিবেশনেই খাদ্য নিরাপত্তা আইন, ভূমি অধিগ্রহণ আইন সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হওয়ার কথা ছিল, অন্তত পক্ষে সেই বিষয়ে বিলগুলি পেশ করিয়া তাহার উপর বিশদ আলোচনা হইতে পারিত। কিন্তু সরকার ও বিরোধী, উভয় পক্ষের অনমনীয়তার ফলে কার্যত চলতি অধিবেশনটি ভণ্ডুলই হইয়া গেল। বিরোধীরা আইনমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, এমনকী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকায় সংসদের কাজ চালানো অসম্ভব হইয়া পড়ে। অন্য দিকে সরকার পক্ষও কোলগেট কেলেংকারির সিবিআই তদন্তপ্রক্রিয়া প্রভাবিত করার দায়ে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অভিযুক্ত হইয়াও এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীকে কোনও ভাবে দায়ী না-করায় বিরোধীরা উত্তরোত্তর আরও বেশি অনমনীয় হইয়া ওঠেন।
সমগ্র ঘটনাপরম্পরায় এবং বিগত বেশ কয়েকটি লোকসভার ক্রিয়াকলাপের পর্যালোচনায় একটি ধারণা ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করা দূরস্থান, সেগুলির মর্যাদা ও কার্যকারিতা সম্পর্কেও সম্ভবত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকেরই সম্যক কোনও ধারণা গড়িয়া ওঠে নাই। যে ভাবে একের পর এক অধিবেশন ভণ্ডুল করা হইতেছে, শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষ যে ভাবে পরস্পরকে কোণঠাসা করার মঞ্চ হিসাবে সংসদকে ব্যবহার করিতেছেন, তাহাতে জাতির মূল্যবান তহবিল ও সময় অপচয় করিয়া জনস্বার্থ বিষয়ক আলোচনা, বিতর্ক, আইন প্রণয়নের আবশ্যিক কৃত্যগুলি ব্যাপক ভাবে উপেক্ষিত হইতেছে। সংশয় হয়, এমন অনেকেই সংসদে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হইয়া আসিতেছেন, যাঁহাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে হয়তো কোনও ধারণা নাই, সেই ব্যবস্থাটি সচল রাখায় জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও কিছু জানা নাই। তাঁহারা কেবল মনে করেন, চিৎকার করিয়া, আস্ফালন ও হুমকি দিয়া, চেয়ার-টেবিল-মাইক্রোফোন ভাঙিয়া সভার কাজ বানচাল করার অধিকারই গণতন্ত্র। এই ধরনের বিশৃঙ্খলার তাড়নায় সংসদ অচল হইতেছে, আবার ইহাই পরোক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংসদীয় এজেন্ডাও নির্ধারণ করিয়া দিতেছে। সংসদীয় মঞ্চকে রক্ষা করিতে হইলে নিবারণী ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। সংসদকে মল্লভূমিতে রূপান্তরিত করার দায়ে জরিমানা বাবদ হাজিরা-ভাতা কাটিয়া লওয়া, উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য সাংসদ-পদ কাড়িয়া লওয়া, এমনকী সাংসদদের তাণ্ডবের জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় দলকেও নির্বাচনে যোগদানের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করার মতো কঠোর ব্যবস্থা লওয়ার সময় আসিয়াছে। প্রশ্ন হইল, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধিবে কে? কোনও দল বা সরকারই কি এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করিতে উদ্যোগী হইবে? সাংসদদের বেতন-ভাতা সহ অন্য রকমারি সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাবে যে সর্বদলীয় ঐকমত্য দ্রুত অর্জিত হইয়া থাকে, দোষী সাংসদদের ‘শাস্তি’র সম্ভাবনা খতাইয়া দেখিতে তেমন কোনও তৎপরতা পরিদৃষ্ট না-হওয়ারই সম্ভাবনা। কারণটি সহজবোধ্য। সংসদ যে গণতন্ত্রকে সজীব রাখার প্রধান উপাদান, এই সত্যটি কদাচিৎ সাংসদরা উপলব্ধি করিয়া থাকেন। বস্তুত, যাহাকে ‘আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্র’ বলা হইয়া থাকে, এ দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে তাহার মানসিকতা আজও যথেষ্ট প্রোথিত হয় নাই। গণতন্ত্রকে সমাজের গভীরে লইয়া যাওয়ার জন্য কেবল জনসাধারণের সর্ব স্তরের প্রতিনিধিত্ব আইনসভায় প্রতিফলিত করানোই যদি যথেষ্ট হইত, তবে মণ্ডলায়ন জনপ্রতিনিধিত্বকে যে ব্যাপকতা দিয়াছিল, তাহাই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হইয়া উঠিত। বাস্তবে দেখা যাইতেছে, সমাজের গভীরে রাজনীতির প্রসারের ফলে আইনসভায় স্থান করিয়া লওয়া জনপ্রতিনিধিদের তরফেই সংসদীয় মঞ্চ অপব্যবহারের ঘটনা সর্বাধিক ঘটিতেছে। অথচ সংসদই গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ। ইহার কার্যকারিতা ক্রমশ নষ্ট করিয়া দিলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া উঠিবে। |