প্রবন্ধ ২...
‘সেই শূন্যগর্ভ গীতাঞ্জলি নয়’
ইটির নাম Talks in China. ১৯২৪-এ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সে বইয়ে ছিল সে বছর ১২ এপ্রিল থেকে ৩০ মে চিনে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের কিছু বক্তৃতা। সেগুলি বক্তৃতা হিসেবেই ছাপা হয়েছিল, স্থাননির্দেশ-সহ। তখনও তাদের ছেঁটেকেটে মিলিয়েমিশিয়ে প্রবন্ধ করা হয়নি। সেটা হয়েছিল তড়িঘড়ি তৈরি ১৯২৫-এর সংস্করণে। তার ভূমিকায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ আগেরটিকে সম্পূর্ণ ‘ভ্যানিশ’ করে জানাচ্ছেন, বক্তৃতাগুলি এই প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হচ্ছে এবং ‘দ্য টেক্সট ইজ বেসড মেনলি অন নিউজপেপার রিপোর্টস অ্যান্ড হ্যাজ নট বিন রিভাইজড বাই দ্য পোয়েট’। তা হলে বক্তৃতাকে প্রবন্ধ করে দিলেন কে?
কবি অথবা অ-কবি, যিনিই করুন পরিবর্তনটা হয়েছিল। ১৯২৪-এর সংস্করণে ১৯টি বক্তৃতার সবটাই নিরীহ, নির্দোষ ছিল না। নিশিদিনমান কর্ম-অনুরত যে প্রবীণ প্রাচীন চিনের বইয়ে-পড়া ছবি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে বাস্তবের তফাত ঘটে গিয়েছিল অনেকটাই। কয়েক বছর আগেই ঘটে গিয়েছে ৪মে-র ঐতিহাসিক আন্দোলন। দেশ জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া। যন্ত্রশিল্প আর অর্থনৈতিক উন্নতির পথে তখন এগিয়ে যেতে চাইছে চিন, ঝেড়ে ফেলতে চাইছে স্থবির আধ্যাত্মিকতা। পরিবর্তনের এই ঝোড়ো হাওয়ায় কী বলবেন কবি, সেই দ্বিধা ছিল তাঁর প্রথম বক্তৃতাতেই: ‘আপনাদের ধর্ম এবং প্রথা সম্পর্কে এত বিরোধী মতামতের কথা আমি পড়েছি যে ভাবছিলাম এঁরা আমাকে কিসের জন্য আমন্ত্রণ করেছেন, এঁদের কল্যাণের জন্য কোন্ বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য।’
শিল্পী: জু পিয়ং
এই দ্বিধার কারণ যে ছিল সেটা বোঝা গিয়েছিল ক্রমে, রবীন্দ্রনাথের ৪৯ দিনের চিনভ্রমণে। ক্রমেই জমে উঠছিল সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধও। এমনকী, পেইচিং বক্তৃতামালার দ্বিতীয় দিনে ছাত্রেরা হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করল রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। শিশিরকুমার দাশের করা তার অনুবাদ থেকে বোঝা যায় কতটা তীব্র ছিল প্রতিক্রিয়া: ‘আমাদের কৃষি চাষীর ক্ষুধা নিবারণে অক্ষম, আমাদের শিল্প কুটির শিল্প মাত্র, আমাদের নৌকা, আমাদের যান বাহন দিনে কয়েক মাইলের বেশি যেতে অসমর্থ,... আমাদের পথঘাট আমাদের শৌচাগার, আমাদের রন্ধনশালা পৃথিবীর চোখে হাস্যকর। অথচ রবীন্দ্রনাথ বস্তুসভ্যতার আধিক্যের জন্য আমাদের তিরস্কার করছেন। তাই আমরা তাঁর প্রতিবাদ করতে বাধ্য।... রবীন্দ্রনাথ বলছেন ব্রহ্মের কথা আত্মার মুক্তির কথা। এই অকর্মণ্য তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমাদের আপত্তি।’ আর রবীন্দ্রনাথ সাংহাই পৌঁছবার দু’দিন পরে চিনা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম যুগের নায়ক মাও তুন একটি পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের প্রত্যাশা’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে যে উপহার আমরা প্রত্যাশা করি তা আধ্যাত্মিক জীবনসাধনা নয়, সেই শূন্যগর্ভ গীতাঞ্জলি নয়, বরং সেই বেদনা ও উৎসাহ জাগানো ‘একলা চলো রে’।’ এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মুগ্ধললিত অশ্রুগলিত রবীন্দ্রচর্চায় উধাও হয়ে রইলেন। বক্তৃতাগুলি অসম্পাদিত, না-সাজানো অবস্থায় পড়লে রবীন্দ্রনাথের মানসিক দ্বন্দ্বটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানে আগের বক্তৃতার ক্ষতে পরের বক্তৃতায় প্রলেপ লাগানোর চেষ্টাও করছেন তিনি। সেটা স্বাভাবিক। কারণ চিনে তিনি শুধু কবি নন, বিশ্বভারতীর স্রষ্টা।
কিন্তু যেমন ছিলেন তেমনই থাকা রবীন্দ্রনাথ পড়ায় আমাদের মতি নেই, অনেক ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রঠাকুরকে গড়ে নিতে হয় আমাদের। তাই, আজও নানা রবীন্দ্রনাথের কোটি কোটি মালা প্রকাশিত হয়ে গেলেও চিনে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের সব বক্তৃতার ভিত্তিতে তাঁকে কেউ নতুন করে পড়লেন না।

ঋণ: বিতর্কিত অতিথি, শিশিরকুমার দাশ ও তান ওয়েন, দে’জ পাবলিশিং


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.