|
|
|
|
দুর্নীতির দায়ে ইস্তফা, সে এখন ইতিহাস |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
জওহরলাল নেহরু তখন প্রধানমন্ত্রী।
কলকাতার এক ব্যবসায়ী হরিদাস মুন্দ্রাকে বেআইনি ভাবে অনেকগুলি জীবন বিমা সংস্থা কেনার অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৎকালীন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারির উপর। এই মুন্দ্রা ১৯৫৪ সালে ব্যবসা শুরু করে দু’বছরের মধ্যে ধনকুবের হয়ে ওঠেন। ’৫৭ সালের শেষ দিকে সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত রাজ্যসভায় কৃষ্ণমাচারির বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড় তোলেন। কৃষ্ণমাচারি দাবি করেছিলেন, “আমি হরিদাস মুন্দ্রা নামটাই কোনও দিন শুনিনি।” কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় নেহরুকে চিঠি দিয়ে বলেন, অসত্য বলছেন অর্থমন্ত্রী। আর মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নেহরুকে বলেছিলেন, “তুমি যদি ওর ইস্তফা গ্রহণ না করো, তা হলে আমি ইস্তফা দেব।” কৃষ্ণমাচারিকে সে দিন পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। নেহরু জমানাতেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের বিরুদ্ধে জিপ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি তাঁর সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করেন। তখন মেননকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও নেহরু তাঁকে পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেই নিয়ে এসেছিলেন। |
জওহরলাল নেহরু |
ইন্দিরা গাঁধী |
রাজীব গাঁধী |
|
বস্তুত দুর্নীতি জিনিসটা ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আবহমান কাল ধরেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি তাঁর ‘কলিযুগ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, কৌটিল্যের সময় থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে কী ভাবে দুর্নীতির শিকড় লুকিয়ে রয়েছে। নেহরু নিজেই বলেছিলেন, “আমরা একটা দুর্নীতির পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছি।” সেই দুর্নীতির পরম্পরা আজও চলছে। শুধু বদলে গিয়েছে তার সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকেরই মতে, দুর্নীতি সম্পর্কে আজকের সমাজে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠেছে। অনেক রাজনৈতিক নেতাও বলছেন, নির্বাচনী প্রচারে দুর্নীতির কথা তুলে ধরে আমজনতার মন পাওয়া যায় না।
কূটনীতিক এবং লেখক পবন বর্মা তাঁর ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান মিডল ক্লাস’ বইতে বলেছেন, ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় এই দুর্নীতির প্রশ্নে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক আমূল পরিবর্তন আসে। ইন্দিরার মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন বাবু জগজীবন রাম। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই অভিযোগ করেন, জগজীবন রাম দশ বছর ধরে আয়কর রিটার্ন দেননি। ইন্দিরা মনে করেন, মোরারজি আগে থেকেই বিষয়টি জানতেন। কিন্তু কংগ্রেসের ভাঙনের মুখে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। ফলে জগজীবন রামকে তিরস্কার করলেও তাঁর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেননি ইন্দিরা। তাঁকে আড়াল করে বলেছিলেন, জগজীবন রাম ব্যস্ত লোক। রিটার্ন জমা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।
নেহরু আমলে দুর্নীতি থাকলেও এই আড়াল করার ব্যাপারটা ছিল না। এক বার রেলমন্ত্রী হনুমান কাপ্পার সঙ্গে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরোধ বেধেছিল। সেই বিরোধের জেরে দু’জনকেই ইস্তফা দিতে হয়েছিল। আবার রেলের দুর্ঘটনার দায় নিয়ে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ইস্তফা দেওয়া তো ঐতিহাসিক ঘটনা। আর আজ! সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে সিবিআই বলছে, তাদের তদন্ত রিপোর্টের খসড়া আইনমন্ত্রী কী ভাবে বদলেছেন। অন্য দিকে রেলমন্ত্রী পবন বনশলের ভাগ্নে ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লেন। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন রেল বোর্ডের সদস্য মহেশ কুমার। বনশলের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু কংগ্রেসের কোর গ্রুপের সিদ্ধান্ত, তাঁরা ইস্তফা দেবেন না।
আসলে সমাজ ব্যবস্থার শীর্ষ থেকে নীচের স্তর পর্যন্ত প্রবাহিত দুর্নীতির ফল্গুধারা। নেতারা একটু-আধটু দুর্নীতি করবেন, এটা যেন এক প্রকার মেনেই নেওয়া হয়েছে। তাই দাউদ-ঘনিষ্ঠ বলে টাডায় অভিযুক্ত হয়ে মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরেও জেল থেকেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন কল্পনাথ রাই। |
নরসিংহ রাও |
অটলবিহারী বাজপেয়ী |
মনমোহন সিংহ |
|
ইন্দিরার আমল থেকেই এই পরিবর্তনের সূত্রপাত। পবন বর্মা সেই পর্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘এন্ড অফ ইনোসেন্স’। ১৯৭১ সালের ২৪ মে অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার রুস্তম সোহরাব নাগরওয়ালাকে ষাট লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার চিফ ক্যাশিয়ার দেবপ্রকাশ মলহোত্র। মলহোত্রর দাবি ছিল, ইন্দিরা গাঁধীর ফোন পেয়েই তিনি টাকা দিয়েছেন। নাগরওয়ালাও গোড়ায় বলেন, ইন্দিরার নির্দেশেই তিনি টাকা নিয়েছিলেন। পরে বিবৃতি বদলে জানান, তিনি টাকা আত্মসাৎই করেছিলেন। চার বছর জেল হয়েছিল নাগরওয়ালার। এক বছরের মধ্যেই জেলে হৃদরোগে মারা যান তিনি। গোটা ঘটনাটি নিয়ে সংসদে তুলকালাম হয়েছিল।
সরকার অবশ্য দাবি করেছিল, সবটাই মিথ্যা প্রচার। প্রধানমন্ত্রী কি এ ভাবে কাউকে ফোন করতে পারেন! কিন্তু ইন্দিরা জমানার গায়ে দুর্নীতির একটা কালো দাগ রেখেই গিয়েছে এই রহস্যময় ঘটনা।
দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সঞ্জয় গাঁধীর মারুতি কারখানা ঘিরেও। ১৯৭১ সালে দেশীয় প্রযুক্তিতে জনতার গাড়ি তৈরির জন্য বরাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। সঞ্জয়ের সংস্থার কোনও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাদেরই বরাত দেওয়া হয়। তখন প্রশ্ন ওঠে, অনেক সংস্থা আবেদন করলেও কেন সঞ্জয়ের সংস্থাকেই বেছে নেওয়া হল? ইন্দিরা তখন বলেছিলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনও ভূমিকাই পালন করেননি তিনি। সঞ্জয় নিজের মতো ব্যবসা করছে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে কোনও বাড়তি সুযোগ পায়নি। সঞ্জয়ের জীবৎকালে একটিও গাড়ি তৈরি করেনি মারুতি। ফলে দুর্নীতির সন্দেহটা থেকেই গিয়েছে। ইন্দিরার পর রাজীবের আমলেও বফর্স দুর্নীতি নিয়ে তুলকালাম হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ, দেবগৌড়া, আই কে গুজরালের ক্ষণস্থায়ী সরকারের আমলেও। নরসিংহ রাওয়ের আমলে সাংসদদের টাকা দিয়ে সরকার বাঁচানোর অভিযোগ উঠেছিল। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে ঘুষ দেওয়ার দাবি করে সাড়া ফেলে দেন শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়ক হর্ষদ মেটা।
তার পর অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমল। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির দাবি, “তখন প্রশাসন ছিল দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে সে ভাবে কাউকে ইস্তফা দিতে হয়নি।”
যদিও সেই দাবি উড়িয়ে কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, “প্রমোদ মহাজন যখন টেলিকমমন্ত্রী ছিলেন, তখনও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। অনন্ত কুমার থেকে শুরু করে অনেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে। কিন্তু বাজপেয়ী তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরুদ্ধেও কফিন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল।”
অতএব নেহরু যে দুর্নীতির আবহের কথা বলেছিলেন, তা আজও বহাল। তফাত একটাই। তখন তাও মন্ত্রীরা ইস্তফা দিতেন। এখন দেন না। |
|
|
|
|
|