বিয়ের দানসামগ্রী থেকে অন্নপ্রাশনের ঝিনুকবাটি, দৈনন্দিন সাংসারিক কাজকর্ম থেকে পুজোপার্বণ সবেতেই এক সময় কদর ছিল কাঁসা-পিতলের বাসনপত্রের। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগান দিতে হিমশিম খেতেন কাঁসা-পিতল শিল্পের কারিগররা। সেই সময় শুধু জেলায় নয়, অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর থানার চন্দনপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পের সুনাম। তবে সে সব এখন অতীত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সস্তা ও আকর্ষণীয় হিসেবে কাঁসা-পিতলের জায়গা নিয়েছে আধুনিক হাল ফ্যাশনের কাচ, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, চিনা মাটি ও সেরামিকের বাসনপত্র। চাহিদার অভাবে সঙ্কটে তাই ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প। চন্দনপুরের প্রায় তিন হাজার কারিগর কাজ না পেয়ে নেমে পড়েছেন বিকল্প জীবিকার সন্ধানে। কেউ পানের বরজ আবার কেউ একশো দিনের প্রকল্পে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু এই সঙ্কটের সময়েও চন্দনপুরের প্রায় দুশোটি পরিবার পুরনো জীবিকা আঁকড়েই টিকে থাকার চেষ্টা করছে। মহাজনি কারবার, সরকারি উদাসীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সংগঠনও গড়েছে তারা। |
চন্দনপুরের কালীপদ রানা রাজ্য ক্ষুদ্র ও শিল্পাধিকার দফতর আয়োজিত কারুশিল্প প্রতিযোগিতায় একাধিক বার সেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। কিন্তু এখন আর প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে মন চায় না কালীপদবাবুর। তিনি বলেন, “এক সময় জোগান দিতে হিমশিম খেতে হত, আর এখন কাজের অভাবে সময়ই কাটতে চায় না। পেটের ভাত জোগাড় না হলে পুরস্কার জিতে কী হবে।” আর এক কারিগর ভবতারণ সাউয়ের কথায়, “কাঁসা-পিতলের দাম অনেক বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ কম দাম ও ওজনে হালকা সেরামিক, কাচের বাসনের দিকে ঝুঁকছেন। তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টাও তো নেই সরকারের।”
চাহিদা কমার পাশাপাশি মূলধনের অভাবে ধুঁকছে কাঁসা পিতল শিল্প। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মহাজনদের দৌরাত্ম্য। দরকারের সময় মূলধন জুগিয়ে নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে শিল্পসামগ্রী তুলে নিচ্ছে মহাজনেরা। পরে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে দেদার। আর কারিগররা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়ে অভাবের তাড়নায় দিন কাটাচ্ছেন। সরকারি উদাসীনতা আর দীর্ঘ বঞ্চনার শিকার কারিগররা তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে তৈরি করেছেন এক নতুন সংগঠন‘চন্দনপুর কাঁসা-পিতল সমাজ কল্যাণ সমিতি’।
সমিতির সভাপতি অশ্বিনীকুমার রানা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আগের হোক বা এখনকোনও সরকারই কাঁসা-পিতল শিল্পের উন্নতির জন্য উদ্যোগী হয়নি। এমনকী ব্যঙ্ক বা অন্য কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের সুবিধা থেকেও আমরা বঞ্চিত।” ওই সমিতি ইতিমধ্যেই স্থানীয় বিধায়ক অখিল গিরির সহায়তায় কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কারিগর ও শিল্পীদের পরিচয় পত্র আদায় করেছে। কাঁসা-পিতল শিল্পকে কুটির শিল্পের আওতায় এনে ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা ও ফড়েদের হাত থেকে কারিগরদের বাঁচাতে জোরদার হচ্ছে সমিতির আন্দোলন। প্রশাসন কী করছে?
রামনগর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দেবব্রত দাস জানান, কাঁসা-পিতল শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। আর রামনগর ১ ব্লকের উন্নয়ন আধিকারিক তমোজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “চন্দনপুরের কাঁসা-পিতল কারিগররা যাতে ব্যাঙ্ক ঋণ পান, তার জন্য ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ চলছে।”
শুকনো আশ্বাসে কাজ হচ্ছে কই? |