বাইরের কেউ জানতে চাইলে তাঁরা জবাব দেন, ‘পিকনিক হবে, অফিসের বন্ধুরা মিলে বিরিয়ানি, মাংস খাব। তাই কিছু টাকা তোলা হচ্ছে।’ কখনও বলা হয়, ‘অমুকের মেয়ের বিয়ে, তাই উপহারের টাকা তোলা হচ্ছে।’ আদতে সেই টাকায় স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন বিভাগে বছরের পর বছর চড়া সুদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানতি কারবার চলছে বলে অভিযোগ। কর্মীরাও জানেন এটা বেআইনি। সরকার নোটিস দিয়ে জানিয়েছে, এ ধরনের কারবারে যুক্ত থাকলে কড়া শাস্তি হবে। তার ফলে গোপনীয়তা বেড়েছে, কিন্তু আমানতি কারবার বন্ধ হয়নি।
স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, কয়েক জন কর্মীই এই কারবারের উদ্যোক্তা। তিন বছরে টাকা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা অন্য কর্মীদের থেকে আমানত সংগ্রহ করছেন। সেই টাকা অনেক সময় খাটানো হচ্ছে নানা ফাটকা কারবারে। সারদা-কেলেঙ্কারির পর এ ব্যাপারটি নিয়েও তদন্তের দাবি তুলছেন উদ্বিগ্ন কর্মীরা।
মহাকরণে এ ভাবে আমানতি কারবার চালানোর অভিযোগ এর আগেই উঠেছিল। শাসক দলের সমর্থক তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কিছু কর্মীর চালানো একটি আমানতের বিরুদ্ধে কর্মীদের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও উঠেছিল। সেটির নাম ‘তৃণমূল এমপ্লয়িজ ফেডারেশন ওয়েলফেয়ার কো-অপারেটিভ ফান্ড’। ক্যানসারে আক্রান্ত সরকারি কর্মী আরতি সাহার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ওই মামলার চার্জশিট পেশ করে মহাকরণের তিন কর্মীর নামে। সম্প্রতি অভিযুক্তেরা আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। কিন্তু তার পরেও মহাকরণে এই কারবার বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ। এ বার সেই অভিযোগ উঠল স্বাস্থ্য দফতরেও।
স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরাই জানিয়েছেন, বছর দু’য়েক আগে কর্মীদের কাছ থেকে টাকা তুলে কয়েক জন কর্মী ফাটকাবাজির ব্যবসায় নেমে পড়ে। এতে বহু টাকা ডুবে যায়। কর্মী অসন্তোষ স্বাস্থ্যকর্তাদের কানেও পৌঁছয়। তদন্তের পরে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কয়েক জন কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়। তিনটি আমানতও তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও স্বাস্থ্যভবনে আমানতি ব্যবসা বন্ধ করা যায়নি। স্বাস্থ্যভবনের অ্যাকাউন্টস-ভেরিফিকেশন বিভাগে এ রকম কারবার সব চেয়ে বেশি চলছে বলে অভিযোগ। যদিও স্বাস্থ্যকর্তারা তা স্বীকার করছেন না।
তাঁরা মানতে না চাইলেও কর্মীদের অভিযোগ, নিতাই মান্না নামে নার্সিং বিভাগের এক কর্মী বেশ কয়েক বছর এ ধরনের কারবার চালাচ্ছেন। তাঁর কাছে প্রায় দেড়শো কর্মীর টাকা খাটছে। এ ব্যাপারে নিতাইবাবুর জবাব, “মাসে মাসে ২০০-৫০০ টাকা করে জমা রাখা হয়। কর্মীরা আপদে-বিপদে, পারিবারিক অনুষ্ঠানে এই তহবিল থেকে টাকা ধার পেতে পারেন।” মার্ট বিভাগে হরষিত মজুমদার নামে এক করণিকও এই আমানতি কারবার চালান বলে অভিযোগ। হরষিতবাবুর উত্তর, “যাঁর যখন টাকা-পয়সা দরকার লাগে নিতে পারেন, এর মধ্যে দোষটা কোথায়! তবে বলছেন যখন এ’টা বেআইনি, তখন বন্ধ করে দেব।” অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন কর্মকারও এই রকম কারবারে যুক্ত বলে অভিযোগ। তাঁর উত্তর, “অনেকেই তো করে। আমরাও ছোট ভাবে করি। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ের জন্য কর্মীরা এখান থেকে টাকা ধার নিতে পারেন।”
এই সব কারবারে টাকা রেখেছেন এমন কয়েক জন কর্মী জানিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে ১০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত মাসে মাসে তোলা হয়। কর্মীরা এক বছরের জন্য অত্যন্ত চড়া সুদে (বার্ষিক ৩৬%) টাকা ধার নিতে পারেন। তার কোনও রসিদ মেলে না, আমানতকারীদের নামও লেখা হয় সাদা কাগজে। ফলে লেনদেনের কোথাও কোনও লিখিত প্রমাণ থাকে না বলে তাঁদের অভিযোগ। |