খেলাধুলা...
সুভাষ এক, বাকিরা দুই তিন চার...
মুদ্র সৈকতে বালির উপর লাইন দিয়ে দৌড়চ্ছেন ফুটবলাররা। পিছনে একটা জিপে টুপি মাথায় চলেছেন তিনি। দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির।
সেনা ছাউনিতে কমান্ডাররা যে ভাবে ট্রেনিং করান, একেবারে সেই চাউনি। হইচই পড়ে গিয়েছিল ময়দানেসুভাষ ভৌমিকের ‘কমান্ডো ট্রেনিং’ দেখে!
সে বার কোচের উপর দল তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। কোন ফুটবলারকে কত টাকা দেওয়া হবে তা-ও ঠিক করেছিলেন নিউ আলিপুরের ভদ্রলোক।
ইয়ান বার্গার, রামিজ দাউব, সেবাস্তিয়ানের মতো বিদেশি নিয়ে এসেছিলেন। পুরীর স্বর্গোদ্বার থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরের একটি রিসর্টে ঘাঁটি গেড়েছিলেন সুভাষ।
বাংলায় শুধু নয়, ভারতীয় ফুটবলে এরকম প্রাক-সিজন ট্রেনিং সম্ভবত কখনও হয়নি। সুভাষ পনেরো দিন পুরীতে পড়েছিলেন টিম নিয়ে। তাঁর প্রতি ঘণ্টা-মিনিটের টিম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকা দেখে মনে হত ইস্টবেঙ্গল ছাড়া ‘টাইগার’-এর জীবনে মনে হয় আর কিছু-ই নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাফল্য পাননি তিনি। ব্যর্থতার স্টিকার গায়ে সেঁটে লাল-হলুদের কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

হেনরি, সুভাষ ভৌমিক
তারও আগে ২০০৬-য়ে মহমেডানের কোচ হয়েও ফুটবলার সই করানো নিয়ে তীব্র বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সুভাষ। কোচিং জীবনে সরকারি ভাবে প্রথম বার টিম করতে নেমেছিলেন তিনি। রহিম নবি, মেহতাব হোসেন, সুরেশ, তুলুঙ্গার মতো ফুটবলারকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল থেকে। চুক্তি সংক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরে চলা ঝামেলার পর সুভাষের টিম শেষ পর্যন্ত সাফল্য পায়নি। ফোকাসটাই নড়ে গিয়েছিল।
২০০৩-০৪য়ে শেষ বার ইস্টবেঙ্গলকে সাফল্যের চূড়ায় তুলেছিলেন। তারপর গত দশ বছরে সুভাষের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কোচিং জীবনেও বহু উথাল-পাথাল হয়েছে। ঝড় বয়ে গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল, সালগাওকরের অবনমন বাঁচিয়েছেন। কোচিং করিয়েছেন মোহনবাগানেও। কিন্তু ট্রফি জয় না, আসেনি।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আবার ফিরে এসেছেন সুভাষ। এমন ঔজ্জ্বল্য নিয়ে যে, তাঁকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে ভারতীয় ফুটবলে। ‘ন্যাড়া দু’বার বেলতলায়’ গিয়ে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও নিজে হাতে টিম তৈরি করার ঝুঁকি নিয়েছেন চার্চিল ব্রাদার্সের। সেই চার্চিলই ফের আই লিগ জেতার সামনে। বাংলা ছেড়ে গোয়ায় গিয়ে নতুন আবহাওয়া, অপরিচিত পরিবেশ। তার মধ্যেই দেশের প্রথম কোচ হিসাবে দু’টো ভিন্ন ক্লাবকে আই লিগ জেতানোর বিরল কৃতিত্বর সামনে তিনি। এবং মনে রাখতে হবে সেটা দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে। ব্যর্থতা নিয়ে শেষ হয়ে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ানোর এই অনন্য উদাহরণ, এ দেশের ফুটবলে এই নজির কারও নেই।
শুধু তাই নয়, কার্যত তারকাহীন একটা দলকে নিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে। মরসুমের মাঝপথে একটা সময় এমন হয়েছিল যে, চার্চিল ফুটবলাররা দু’তিন মাস মাইনে পাচ্ছিলেন না। সুভাষ তাঁদের খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন নিজের খরচে। টিম যখন ছন্দে তখন দলের দুই সেরা বিদেশি আক্রম আর বিলাল চলে যান ক্লাব ছেড়ে। এর সঙ্গে চার্চিল ভাইদের নানারকম চাপ তো আছেই। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অনেকেই তাই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, সুভাষ কি তা হলে এই প্রজন্মের সেরা কোচ?
“ভোম্বলবাবু মনে হচ্ছে সাফল্যে আমাকেও ছাপিয়ে যাবে। লক্ষ্যে স্থির থাকলে ওকে ধরা মুশকিল। যাঁরা কোচিং করেন, তাঁরা জানেন দুই রাজ্যের দু’টো টিমকে আই লিগ জেতানো কী কঠিন। কী রকম দুঃসাধ্য ব্যাপার। ওর উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছে। তাতেও টলেনি। এই প্রজন্মের সেরা কোচের লড়াইতে আমি ওর সঙ্গে দু’জনকে রাখব। একজন আর্মান্দো কোলাসো, অন্য জন সুব্রত ভট্টাচার্য,” বলছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের সর্বকালের অন্যতম সফল কোচ।
সুভাষ সব সময়ই পিকে-র কাছে ‘ভোম্বলবাবু’। ম্যান ম্যানেজমেন্ট থেকে টিমকে উদ্বুদ্ধ করার কৌশল। ‘গুরু’ পিকের প্রচুর প্রভাব রয়েছে ‘ছাত্র’ সুভাষের কোচিং ম্যানুয়ালে। সেটা মানেন চার্চিল কোচ নিজেই। ছাত্রের সাফল্যে পিকে এতটাই উচ্ছ্বসিত যে বলে ফেললেন, “ভাবছি ও চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরলে সস্ত্রীক সংবর্ধনা দেব বাড়িতে ডেকে। খাওয়াব, উপহার দেব। ডাকব আমার পুরোনো ছাত্রদের।”
পিকে যে দু’জনকে সুভাষের সঙ্গে এই প্রজন্মের সেরা কোচের লড়াইতে রাখছেন, তাঁদের মধ্যে ডেম্পো কোচ আর্মান্দো কোলাসোর পারফরম্যান্স চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। পাঁচ পাঁচটা আই লিগ। সঙ্গে বেশ কয়েক বার ফেড কাপ-সহ অন্য ট্রফি। আর্মান্দো নিজে কী মনে করছেন? গোয়ায় যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, “পাঁচটা আই লিগ তো কারও নেই। আমি ডেম্পোকে যা সাফল্য দিয়েছি, তা ভারতের কোনও কোচ কোনও ক্লাব পারেনি। এ বার আপনারা ঠিক করুন কে সেরা।”
কিন্তু আর্মান্দো তো ছিলেন ডেম্পোর সর্বেসর্বা। ফুটবল সচিব, কোচ সবই। তিনিই টিম গড়তেন নিজের মতো করে। ফলে সেই অর্থে তাঁর চাকরি যাওয়ার চাপ ছিল না। যেটা সুভাষ বা সুব্রতদের সব সময় থাকে। এই প্রজন্মের সেরা কোচ হওয়ার যুদ্ধে আর্মান্দো নিজেকে রাখতে চাইলেও, সুব্রত ভট্টাচার্য অবশ্য তাতে সামিল হতে চাইছেন না। মোহনবাগানকে দু’বার আই লিগ দেওয়া সুব্রত কোচিং জীবনে দেশের সব ট্রফি জিতেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সুভাষের কৃতিত্বকে কুর্নিশ জানাতে চান।
লিওনেল মেসি থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, অ্যালেক্স ফার্গুসন থেকে ভারতীয় ফুটবল। কেউই সুব্রতর সমালোচনার হাত থেকে বাঁচেননি। সেই সুব্রত কিন্তু দরাজ ‘বন্ধু’ সুভাষের। “ওকে আমি প্রদীপদার পাশেই রাখব। কোলাসো পাঁচ বার আই লিগ জিতেছে ঠিক। কিন্তু ওর সুবিধা ছিল নিজে টিম তৈরি করায় মহেশ গাউলি, ক্লাইম্যাক্স-সহ প্রায় একটা পুরো টিম ধরে রাখতে পেরেছিল। যেটা আই লিগের মতো লম্বা টুর্নামেন্টে বড় ফ্যাক্টর।’’ সঙ্গে সুব্রতর আরও সংযোজন, “সুভাষের মতো আর্মান্দোকে এত লড়াই করতে হয়নি। ক্লাব কর্তাদের সাহায্য পেয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এই প্রজন্মে আমার মতে সেরা কোচ সুভাষই।”

বেটোর পাশে সুভাষ
১৯৭২ ইস্টবেঙ্গলের সোনালি মরসুম ছিল পিকের হাত ধরে। পাঁচটা টুর্নামেন্ট খেলে পাঁচটায় চ্যাম্পিয়ন।
২০০৩-০৪ ইস্টবেঙ্গলে ফের সূর্যোদয়। সুভাষ ভৌমিকের কোচিংয়ে আই লিগ-সহ পাঁচটা ট্রফি। সঙ্গে আসিয়ান কাপ। এ এফ সি-র কোয়ার্টার ফাইনাল।
পিকের পরবর্তী প্রজন্মে ভারতীয় ফুটবলে যে কোচেরা সাফল্যের সরণিতে আছেন তাতে কোলাসো, সুব্রতরা একাধিক বার আই লিগ জিতেছেন।
লড়াইতে অবশ্য রাখা যাচ্ছে না সুখবিন্দার সিংহ, টি কে চাত্তুনি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ডেরেক পেরিরা, করিম বেঞ্চারিফা, জোরান জর্জোভিচ, সাব্বির আলিদের। যাঁরা দেশের এক নম্বর এবং কঠিনতম টুর্নামেন্ট আই লিগ জিতেছেন। তবে মাত্র একবার করে। একাধিক বার নয়। ট্রেভর মর্গ্যানও আলোচনায় আসবেন না আই লিগ জেতেননি বলে।
ফলে লড়াইটা চৌম্বকে আটকে যাচ্ছে সেই পিকে ফর্মুলাতেই আর্মান্দো কোলাসো, সুভাষ ভৌমিক এবং সুব্রত ভট্টাচার্যের মধ্যে।
এদের মধ্যে কে সেরা তা নিয়ে অবশ্য মন্তব্য করতে রাজি নন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। ইস্টবেঙ্গলকে আই লিগ দেওয়া কোচ বলে দিলেন, “কে এই প্রজন্মের সেরা বাছাটা খুব কঠিন। নানা রকম রসায়ন থাকে। তবে অন্য রাজ্যে গিয়ে আই লিগ জেতানো কঠিন কাজ। সেটা সুভাষদা করেছে। ওকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।”
আর সুভাষকে ‘কবিরাজ কোচ’ (কোনও কোচিং ডিগ্রি নেই বলে) বলেও অমল দত্তের মন্তব্য, “আমি চার্চিলে তিন বার কোচিং করিয়েছি। জানি ওদের সঙ্গে কাজ করাটা কতটা কঠিন। কী ভাবে দিনের পর দিন ওদের বোঝাতে হয়। সুভাষ যদি টিমকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারে তা হলে তো কিছুটা কৃতিত্ব পাবেই।”
কী বলছেন সুভাষ ভৌমিক নিজে? “কে সেরা সেটা তো অন্যরা বলবে। আমি কাজে বিশ্বাসী। কোচিং আমার জীবন। সেটাই করে যেতে পারলে আমি খুশি।”
ফের দৌড় শুরু করেছেন সুভাষ। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়। সামনে বেটো, তোম্বা, হেনরিরা। পিছনে তিনি। পুরীর সমুদ্রতটে ‘কম্যান্ডো ট্রেনিং’ ব্যর্থ হয়েছিল। আরব সাগরের বেলাভূমিতে এই ‘দৌড়’ হারিয়ে যাওয়ার নয়।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.