|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ২... |
শতবর্ষ পরে |
গীতাঞ্জলিতে মুগ্ধ ছিলেন কবি ইয়েটস। এই কবিতাগুচ্ছের একটি কবিতা
বুকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ
দিয়েছিলেন কবি আওয়েন। গ্রন্থটির নোবেল
শিরোপা
পাওয়ার একশো বছর পার। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
যে-গীতাঞ্জলির একশো তিনটি কবিতার জন্য একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার, তার পিছনেও একশোটা গল্প আছে। যে-সব গল্প এখন শুনলে গানের মতো শোনায়।
বিনা প্রশ্নে আধুনিক ভারতের বিখ্যাততম বই গীতাঞ্জলি, পাশ্চাত্যে যা রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ বানিয়েছে। কিন্তু দিগন্তপ্রসারী ও আকাশছোঁয়া স্তুতির পাশাপাশি বেচারির কপালে ব্যজস্তুতি ও প্রকট নিন্দেও কম জোটেনি। তাতে যে গীতাঞ্জলির খুব একটা এসে গিয়েছে, তা’ও না। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ টেস্ট রানের গড়ের মতো এও এক দুর্লঙ্ঘ্য কীর্তি। কাল ছিল, আজ আছে, কাল থাকবে।
গল্পে যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা বলি। হালফিল অনেক স্মার্ট, চোস্ত অনুবাদ হয়েছে গীতাঞ্জলির, তার দেদার প্রশংসাও ছড়িয়েছে চারদিকে। কিন্তু তার পরও কেন বার বার ফিরে যাই, আরাম পাই কবির নিজের কাজে? কবির নিজের করা ইংরেজি বলেই নয়, যে-ইংরেজিতে আশ্চর্যের আশ্চর্য বোধ করেছিলেন ইয়েটস, পড়তে পড়তে কখন যেন ভুলেও যাই এ শুধু অনুবাদ। ইংরেজিতেও একটা স্তবগানের মন্ত্রতা পায় গীতাঞ্জলি, ওই ইংরেজিকেও মূল বলে মনে হয়। সে হওয়ারও একটা কারণ আছে, গল্প দিয়েই সেই কারণটা বলি?
অবনীন্দ্রনাথের বন্ধু ইংরেজ কলা শিক্ষক উইলিয়ম রটেনস্টাইন ভারতে এসেছিলেন ১৯১০-১১ সালে। যখনই জোড়াসাঁকো গিয়েছেন, দেখেছেন, বন্ধুর এক কাকা চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শোনেন। সেই মানুষটার মধ্যে রটেনস্টাইন চেহারার প্রবল সৌন্দর্যের সঙ্গে মনের মাধুর্য খুঁজে পাচ্ছিলেন। উনি আঁকতে চেয়েছিলেন কাকার এক প্রতিকৃতি। এর বিশ বছর পর ওঁর আত্মস্মৃতিতে লিখেছিলেন রটেনস্টাইন: কেউ আমাকে এতটুকু আঁচ দেয়নি যে এই কাকা তৎকালের এক অনন্যসাধারণ মানুষ। |
|
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে দেশে ফেরার আগে ওঁর গল্প ও কবিতার অনুবাদ চেয়েছিলেন রটেনস্টাইন। লন্ডনে ফিরেও কবির গল্পই চেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। লন্ডনে আসার জন্য আমন্ত্রণও করলেন। ইতিমধ্যে আনন্দকুমারস্বামীর (যিনি ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা অনুবাদও করেছিলেন) বাঙালি সহযোগী অজিত চক্রবর্তীর করা এক খাতা রবীন্দ্র কবিতার অনুবাদ হাতে এল ওঁর। রটেনস্টাইন টের পেলেন কবির কবিতা তাঁর গল্পের চেয়েও অসাধারণ এবং তাতে অপূর্ব ভাবানুভূতি ছড়িয়ে আছে।
একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। যখনকার কথা এ সব, তখন কবির গল্পের অনুবাদই বেশি পাওয়া যাচ্ছে, কবিতার অনুবাদ ক’টাই বা? রটেনস্টাইন ও কুমারস্বামীর আগ্রহ দেখে রবীন্দ্রনাথ ইংলন্ড যাত্রা মনস্থ করলেন। ১৯১১-র অক্টোবরে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাকে নিয়ে বিলেত যাত্রার জাহাজ-টিকিটও কেনা হল। কিন্তু নানা কারণে যাত্রা বাতিল, অর্শের রোগে তার আগে থেকে শরীরও কাহিল কবির। শেষ অবধি সেই যাত্রা ঘটল ১৯১২ সালের মে মাসে। কিন্তু এই দেরিরও একটা সুদিক আছে।
২৭ মে বোম্বাই থেকে বিলেত পাড়ি দেওয়ার আগে কবি শরীর স্বাস্থ্য ফেরাতে পূর্ববঙ্গের শিলাইদহে যে মাস দুই কাটালেন, তখন প্রায় এক ভূতে পাওয়া দশায় নিজের নানা সংকলন থেকে অজস্র কবিতা অনুবাদ করে গেলেন। এমনকী মাঝসমুদ্রে জাহাজ যখন, তখনও ডেকচেয়ারে বসে দিনে একটা দুটো কবিতা অনুবাদ করেই চলেছেন। তখনও ধারণার বাইরে এই অনূদিত কবিতাগুলোই তাঁর বাকি জীবন কী ভাবে বদলে দেবে। আর আমরা ভেবে অবাক হই, কী হত যদি অজিত চক্রবর্তী কবিতার অনুবাদের বদলে রটেনস্টাইনকে কবির একগুচ্ছ গল্পের অনুবাদই পাঠিয়ে বসতেন!
কবি ইয়েটস |
শেষ অবধি ‘সং অফারিংস’ বলে যে পাণ্ডুলিপি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ১৬ জুন লন্ডনে নামলেন, তার ৫৩টি কবিতা গীতাঞ্জলির, ১৬টি নৈবেদ্যর, ১১টি খেয়ার, ৩টি শিশুর এবং ১টি করে চৈতালি, কল্পনা, অচলায়তন ও উৎসর্গের। আর নামার পরে পরেই লন্ডনের বিখ্যাত টিউবরেলে সেটি হারিয়ে ফেললেন। রক্ষে এই যে লেফট লাগেজ অফিস থেকে গীতাঞ্জলি খুঁজেও পাওয়া গিয়েছিল। সে-পাণ্ডুলিপি পড়ে তো রটেনস্টাইন সপ্তম স্বর্গে। ব্যগ্র হয়ে উঠলেন ইংরেজি ভাষার সেরা কবি ডবলিউ বি ইয়েটসকে পড়ানোর জন্য। তাঁকে চিঠিতে লিখলেনও রটেনস্টাইন: এই কবিতা যা তিনি নিজেও তাই।
রটেনস্টাইনের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটসের প্রথম দেখা হল ২৭ জুন, এক নৈশভোজে। এর পর ৭ জুলাই রটেনস্টাইনের বাড়ির এক সান্ধ্য আসরে ইয়েটস গীতাঞ্জলি থেকে কিছু কবিতা পড়লেন। আর ১০ জুলাই কবির সম্মানে আয়োজিত ত্রোকোদেরো রেস্তোরান্টের এক নৈশভোজে সত্তর জনের মতো অতিথির সামনে ইয়েটস গীতাঞ্জলির তিনটি কবিতা পড়ে শোনালেন। সেখানে অন্যান্য বিশিষ্ট জনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইয়েটসের বান্ধবী মড গান এবং ঔপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলস। আর এর এক সপ্তাহের মধ্যে ইয়েটস গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো সাজানো এবং রবীন্দ্রনাথের বিবেচনার জন্য কিছু কিছু পেন্সিল দাগানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
ওই টুকিটাকি দাগানো এমন কিছুই না। এর পর যে অপূর্ব কাজটি ইয়েটস করলেন তা হল, গীতাঞ্জলির এক অসাধারণ ভূমিকা রচনা। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন ভূমিকাটি ভাসা ভাসা, যদিও ঘটনা এই যে গীতাঞ্জলি একশো বছর পার করার পরও মনে হয় যে পৃথিবীতে খুব কম কবির সংকলনেই অন্য এক মান্য কবির এত সুন্দর ভূমিকা পাওয়া সম্ভব। এক ছোঁয়াচে আনন্দ, বিস্ময় ও সমীহ বয়ে চলে গোটা রচনায়। আমি শুধু তার একটি বাক্যই উদ্ধৃত করব এবং প্রায় অনুবাদের অতীত সেই গদ্যের ইংরেজিটাই তুলে দেব ... “আই হ্যাভ ক্যারেড দ্য ম্যানাসস্ক্রিপ্ট অব দিস ট্রানস্লেশন অ্যাবাউট উইথ মি ফর ডেজ, রিডিং ইট ইন রেলওয়ে ট্রেনস, অর অন দ্য অফ অমনিবাসেস অ্যান্ড ইন রেস্তোরাঁজ্ অ্যান্ড আই হ্যাভ অফ্ন হ্যাড টু ক্লোজ ইট লেস্ট সাম স্ট্রেঞ্জার উড সি হাউ মাচ ইট মুভড মি।” (এই অনুবাদগুলির পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে দিনের পর দিন আমি ঘুরেছি। কখনও ট্রেনে পড়তে পড়তে গিয়েছি। কখনওবা অমনিবাসের ডগায় বসে। অথবা রেস্তোরাঁয়। আর প্রায়ই আমাকে সেগুলো বন্ধ করতে হয়েছে, পাছে কেউ আমাকে দেখে বোঝে, ভেতরে আমার কী তোলপাড় চলছে তখন!)
|
|
|
ইয়েটসের এই মুগ্ধতা কিন্তু নোবেল পুরস্কারের থেকে কিছু কম স্বীকৃতি নয় গীতাঞ্জলির। কিংবা কবি এজরা পাউন্ডের ভালবেসে ফেলা সেই পঙক্তি যেটি রবীন্দ্রনাথ সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে পাঠানো ধন্যবাদ পত্রেও উল্লেখ করেছেন
“কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘর দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।”
অথবা, হায়! হায়!, কবি উইলফ্রেড আওয়েনের বুকপকেটের নোটবইয়ে লিখে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া সং অফারিংস-এর ৯৬ নম্বর কবিতাটি, যেটির অনুবাদও আজও পড়লে মূল ইংরেজি কবিতা বলে ঠাহর হয় : “হোয়েন আই গো ফ্রম হেন্স, লেট দিস বি মাই পার্টিং ওয়ার্ড দ্যাট হোয়াট আই হ্যাভ সিন ইজ আনসারপাসেবল।”
(যাবার দিনে এই কথাটি
বলে যেন যাই
যা দেখেছি যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই।)
সেই যুদ্ধেই প্রাণ দেন আওয়েন।
গীতাঞ্জলির নোবেলের শতাব্দী মানে তো ওই ১০৩টি ইংরেজি তর্জমার সম্মানের শতাব্দী। তাই শেষ করব ইয়েটসের প্রিয় পঙক্তিনিচয় দিয়ে: চিলড্রেন হ্যাভ দেয়ার প্লে অন দ্য সিশোর অব ওয়ার্ল্ডস। দে নো নট হাউ টু সুইম, দে নো নট হাউ টু কাস্ট নেটস।
(জগৎ-পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে খেলা।
জানে না তারা সাঁতার দেওয়া,
জানে না জাল ফেলা।)
এই উদ্ধৃতি দিয়ে ভূমিকা শেষ করেছিলেন ইয়েটস।
|
মডেল: সৌমিলি ঘোষ বিশ্বাস
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|