সারদা গোষ্ঠীর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পরে যখন তার নানারকম ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে তখন একটা বিষয় অনেকটাই আড়ালে থেকে যাচ্ছে, তা হল মানুষ এই লগ্নি সংস্থাগুলিতে টাকা রাখেন কেন। অনেকে অবশ্য বলবেন, এই সংস্থাগুলির সুদের হার এবং নানা লোভনীয় স্কিমে আকৃষ্ট হয়েই মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা না রেখে এখানে রাখছেন। কিন্তু এতে ঝুঁকির ব্যাপারটা আমানতকারীরা হয় খেয়াল রাখছেন না, নাহলে বুঝছেন না। শহর বা মফস্সলে যেখানে ব্যাঙ্ক এবং এই ধরণের সংস্থাগুলোর মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে লোভ টাকা রাখার একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু গ্রামগুলিতে সম্পূর্ণ অন্য এক গল্পের খোঁজ মেলে।
২০০৯ সালে একশো দিনের প্রকল্পের টাকা যখন সরাসরি ব্যাঙ্ক থেকে দেওয়া শুরু হল তখন বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ব্যাঙ্ক এবং পঞ্চায়েতের কর্মীরা অ্যাকাউন্ট নিয়ে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছেন। অনেক পোষ্ট অফিস এবং ব্যাঙ্ক তো কর্মীর অভাবে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি অ্যাকাউন্ট খুলতে রাজিই নন। তাঁরা স্পষ্ট ভাবে সেই সমস্ত মানুষদের ‘জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট’ খুলতে অনিচ্ছা দেখাচ্ছেন যাঁরা টাকা জমাতে পারবেন না এবং ব্যাঙ্কের কাজকর্ম করতে যাঁদের নিয়মিত সাহায্য প্রয়োজন। ফলে এই মানুষগুলোর কাছেও ব্যাঙ্ক একটা অচেনা জায়গা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বলা যায়, দ্রুত হারে গজিয়ে ওঠা অর্থলগ্নি সংস্থা এবং মানুষের ব্যাঙ্কের প্রতি উদাসীন মনোভাব একশো দিনের প্রকল্পে ‘banking behaviour’ এর ব্যর্থতাকে দেখায়। |
ব্যাঙ্কের পরিষেবা নিয়ে গ্রাহকদের নানা অভিযোগ থেকেই গিয়েছে। —নিজস্ব চিত্র। |
বাঁকুড়ার একটি সমীক্ষা বলে, পঞ্চাশের দশকে কংসাবতী বাঁধ নির্মাণের সময় অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। সেই ক্ষতিপূরণের টাকা তাঁরা জমাতে পারেননি কারণ তখন পর্যাপ্ত ব্যাঙ্ক ছিল না। ফলে নানা উৎসব, বিধিতে সেই টাকা খরচ হয়ে যায়। অনেকে জানান, তাঁরা মাটির পাত্রে ভরে মাটির নীচে টাকা লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বর্ষায় তা নষ্ট হয়ে যায়। সম্পত্তি বলতে তাঁরা যেটুকু করেছেন তা হল গবাদি পশু। ষাট বছর আগেও ব্যাঙ্ক না থাকায় মানুষ টাকা খুইয়েছিলেন, আর এই ২০১৩ সালেও শালবনিতে জিন্দল সংস্থার অধিকৃত জমির পাশে এক ডজনেরও বেশি গ্রাম চেনা লোকেদের মাধ্যমে লগ্নি সংস্থাগুলোতে টাকা রেখেছেন। আর বাকি টাকায় তাঁরা টিভি, মোটরবাইক ইত্যাদি কিনেছেন।
ব্যাঙ্কে যাওয়া মানে যেখানে একটা কাজের দিন নষ্ট, সেখানে এই সমস্ত লগ্নি সংস্থার এজেন্টরা সরাসরি বাড়িতে চলে আসছে। এছাড়া ব্যাঙ্কের নানা কাজের মতো ঝক্কিও এখানে নেই। এছাড়া “আমি সারদায় টাকা রেখেছিলাম কারণ আমাদের পাড়ার অমুকবাবু বললেন এতে ভাল টাকা ফেরত পাব”- এই ধরণের কথাবার্তা থেকে বোঝা যায় কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজে কোনও সংস্থার চাইতে পরিচিত কোনও ব্যক্তির প্রতি মানুষের আশ্বাস অনেক বেশি। সারদা গোষ্ঠীর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পরে বহু এজেন্টের পালিয়ে যাওয়া থেকে বোঝা যায়, এই লগ্নি সংস্থাগুলিও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ব্যবসা বাড়াতে এজেন্টদের যোগাযোগ, পরিচিতি, আশপাশের মানুষের তাদের উপর ভরসা, এগুলি ব্যবহার করত।
সুতরাং, লগ্নি সংস্থাগুলির এই বাড়বাড়ন্তের কারণ খুঁজতে গেলে গ্রামীণ এলাকায় খবর কীভাবে পৌঁছয়, সেখানকার লোকজনের টাকা জমানোর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কীরকম সেগুলি দেখাটাও জরুরি। গ্রামবাসীরা প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলেন, তাঁরা টাকা রেখেছেন কারণ তাঁর পরিচিত কেউ রেখেছেন। সুতরাং সঞ্চয় অনেকটাই চেনা-পরিচিতি নির্ভর। জিন্দল সংস্থার প্রকল্পের জন্য গ্রামের বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার পরেই বিভিন্ন লগ্নি সংস্থা থেকে এজেন্টরা এসে তাদের টাকা জমানোর জন্য বোঝাতে শুরু করেন। কারণ, একজন গ্রামবাসী রাজি হওয়া মানেই বাকিরাও তাঁদের অনুসরণ করবেন।
আইনের মাধ্যমে এই সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করলে পরিস্থিতি নিশ্চয় বদলাবে। কিন্তু সেই সঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় মানুষের টাকা জমানোর ধরণ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সেই অনুসারে কর্মসূচী নেওয়ার দিকে জোর দেওয়া উচিত। কড়া নিয়ন্ত্রণ, মানুষের সঞ্চয় প্রবৃত্তি এবং গ্রামীণ এলাকায় ব্যাঙ্ক পরিষেবার বিস্তার, এগুলি নিশ্চিত করতে পারলে সারদার মতো ভুয়ো লগ্নি সংস্থার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। |