কেলেঙ্কারি হলেই হইচই! প্রতারিত মানুষের ক্ষোভের ফায়দা নিতে আসরে সব রাজনৈতিক দল। কিন্তু বৃহত্তর দায়িত্ব পালনে নেই কেউ। সারদা-কাণ্ডে ফের প্রকট এই সুবিধাবাদী রাজনীতিই!
প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে অর্থলগ্নি সংস্থায় (চালু লব্জে চিট ফান্ড) টাকা রাখা যে ভবিষ্যতের জন্য বিপদকেই ডেকে আনা, এই মর্মে প্রচার চালিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ বাম-ডান সব দলই। অথচ শহরে, মফস্সলে, গ্রামে এই ধরনের সংস্থার দৌরাত্ম্য বহু যুগ থেকে। এবং আরও আশ্চর্য, সব দলের নেতা-নেত্রীরাই মেনে নিচ্ছেন তাঁদের এই ব্যর্থতার কথা! তবে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার তৎপরতা বিশেষ চোখে পড়ছে না সারদা-কাণ্ডের পরেও।
বস্তুত, সারদা-কাণ্ড নিয়ে বিতর্কের ঝড়ের মধ্যেই উঠে আসছে একটি গুরুতর প্রশ্ন। সারদার মতো সংস্থার হাতে সাধারণ, গরিব মানুষের ঠকে যাওয়া ঠেকাতে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কোনও দিক থেকেই কোনও আন্তরিক পদক্ষেপ কি হয়েছে রাজ্যে? ছোট-বড় নানান অর্থলগ্নি সংস্থার আবির্ভাব হয় বাম আমলেই। অন্তত বার তিনেক তা বড় আকার নিয়েছে এবং তখন তার প্রতিক্রিয়ায় কিছু পদক্ষেপও হয়েছে। কিন্তু গোড়া থেকে আপদ উপড়ে ফেলা হয়নি। সেই বিপদই ডালপালা মেলে মহীরূহ হয়েছে তৃণমূলের জমানায়! আর এই সূত্রেই রাজ্যের প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক শিবিরে চর্চা হচ্ছে, অশোক মিত্র ছাড়া এই ধরনের সংস্থার বিরুদ্ধে কেউই পর্যাপ্ত ভাবে সক্রিয় হননি।
যে কোনও ঘটনাতেই বামেদের ঘাড়ে দোষ চাপান তৃণমূল নেতৃত্ব। সারদা-কাণ্ডেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তার মধ্যেও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “যাঁরা আজ বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের কিছু বলার অধিকারই নেই! অশোক মিত্র ছাড়া চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে আর সব তো ভোঁ ভাঁ!” প্রবীণ এক সিপিএম নেতাও স্বীকার করছেন, “খুব জেদি মানুষ ছিলেন অশোকবাবু। কোনও বাধ্যবাধকতার সঙ্গে আপস করেননি। সঞ্চয়িতা মামলার জেরে চিট ফান্ডের পিছনে লেগেছিলেন বলে ওঁকে পরের নির্বাচনটাই হেরে যেতে হয়েছিল!”
কী করেছিলেন বাম জমানার প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোকবাবু? বিধানসভা অবং অন্যান্য সূত্রের তথ্য বলছে, মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী এইচ এম পটেল ১৯৭৮-এ ‘প্রাইজ চিট্স অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন ব্যানিং অ্যাক্ট’ পাশ করিয়েছিলেন লোকসভায়। ‘জনপ্রিয়’ নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থা এর পরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। সর্বোচ্চ আদালত ১৯৮০-এর ২৬ সেপ্টেম্বরের রায়ে কেন্দ্রীয় ওই আইনকেই বলবৎ রাখার কথা বলে। ঠিক সেই দিনই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্দেশ জারি করে রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অশোকবাবু ১৩৮টি ওই জাতীয় সংস্থাকে ব্যবসা গোটাতে বলেন। একটি সংস্থা কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে সাময়িক স্থগিতাদেশ পেয়েছিল। কিন্তু অশোকবাবু দমেননি। তাঁর সে সময়ের ভূমিকার দৌলতেই পরবর্তী অন্তত ১০ বছর প্রতারণার কোনও বড় অভিযোগ ওঠেনি।
সিপিএমের প্রবীণ নেতাদের একাংশ মনে করেন, অশোকবাবুর মতো ভূমিকা দল বা প্রশাসনে সকলে নিতে পারলে পারলে ওই ধরনের সংস্থার দৌরাত্ম্যে পূর্ণচ্ছেদ টানা যেত অনেক আগেই। অশক্ত শরীরের স্বয়ং অশোকবাবু অবশ্য এত বছর পরে এ সব নিয়ে প্রশ্ন করলে সবিনয় বলছেন, “আমি দুঃখিত।” তবে সঞ্চয়িতা-পর্ব নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকায়।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বিতর্কে ঢুকতে নারাজ হলেও সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক প্রাক্তন সদস্য বলছেন, “অশোকবাবুর পরে কেউ আর সে ভাবে সক্রিয় হননি। দলের কিছু নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে পরবর্তী কালে এই ধরনের সংস্থাগুলির ঘনিষ্ঠতার কথা উঠে এসেছে। তবে কখনওই তৃণমূলের মতো প্রকট ভাবে নয়! এই সব সংস্থার এজেন্টদের নিয়ে দল ইউনিয়নও করেছে। কড়া হাতে দমন করার কথা তেমন ভাবে ভাবা হয়নি।” যদিও রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর আসনে অশোকবাবুর উত্তরসূরি অসীম দাশগুপ্ত বলছেন, “লিখিত অভিযোগ পেলেই একমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। বাম সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত সেই চেষ্টা হয়েছে। সঞ্চয়িনী, ওভারল্যান্ড, ভেরোনা-র মতো যে সব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম, তারা বা সেই ব্যক্তিরা কি আর পরে মাথাচাড়া দিতে পেরেছে?” আর এত বড় বিতর্কের পরেও বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র সারদা-সহ গোটা বিষয়ে মুখ খুলতেই নারাজ! সদ্য বিধানসভায় তাঁর বক্তৃতা থেকেও কিছু মেলেনি।
এ তো গেল প্রশাসনিক এবং আইনি বিতর্ক। কিন্তু রাজনীতির আন্দোলন? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী শ্যামলী গুপ্ত মানছেন, “বেআইনি মদের ঠেক বা সাট্টা-জুয়ার আসর ভাঙতে আমাদের আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু চিট ফান্ডের মতো সামাজিক বিপদের বিষয়টাকে সে ভাবে ধরা হয়নি। বড় কোনও ঘটনা ঘটলে যেটুকু হওয়ার, হয়েছে।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গ বেকারত্বের গ্রাসে। পোস্ট অফিসের এজেন্টরাও টাকার জন্য চিট ফান্ডে চলে যাচ্ছেন। মানুষের টাকা বাড়ানোর লোভ তো আছেই। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই হল না!” তৃণমূলের প্রবীণ শ্রমিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় মনে করে যা বলতে পারছেন, তা এ-ই “সঞ্চয়িতার (১৯৮০-৮১) সময় এক বার আন্দোলন করেছিলাম! ট্রেড ইউনিয়ন নয়, দলের (তখন কংগ্রেসে) হয়েই।”
প্রকাশ্যে না-হলেও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা আড়ালে স্বীকার করেন, এই ধরনের সংস্থাগুলির এজেন্টরা ছড়িয়ে আছেন সব দলেরই ছত্রচ্ছায়ায়। চাকরির আকালের এই সমাজব্যবস্থার মধ্যে অর্থলগ্নি সংস্থা একেবারে উপড়ে ফেলার আন্দোলন করতে গিয়ে এতগুলো লোকের গ্রাসাচ্ছাদনে ছাই ফেলার ঝুঁকি নিতে চায় না কোনও দলই। সমাজ এবং অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বেরা আরও একটা কথা বলছেন। দেশি মদের বৈধ ব্যবস্থা নেই বলেই গরিব মানুষ যেমন চোলাই মদের খপ্পরে পড়েন, তেমনই অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিও পরিস্থিতির ফায়দা নেয়। গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র আজও ব্যাঙ্ক নেই। ডাকঘরের সঞ্চয় প্রকল্প একেবারে রক্তশূন্য অবস্থায় টিকে আছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘরের মাধ্যমে গরিব মানুষের হাতে যথাযথ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করতেও কোনও রাজনৈতিক দলকে দেখা যায়নি! অথচ সেটা করলে কিছুটা সমস্যার শিকড়ে পৌঁছনো যেত!
সারদা-কাণ্ডের পরে ‘চিট ফান্ড’গুলির প্রতারণা নিয়ে একটি পুস্তিকা তৈরি করেছে ফ্রন্ট। সেখানে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু লিখেছেন, ‘রাজ্যে বর্তমান সময়ে যে গুরুতর সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা রাজ্যবাসীর সামগ্রিক সমস্যারই অঙ্গ। তাই দলমত নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়ে সমাধানের লক্ষ্যে বামপন্থীদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে’। ‘সামগ্রিক সমস্যা’ নিয়ে ‘দলমত নির্বিশেষে’ এত দিন সবাই নির্বিকার ছিলেন কেন, কে জানে! |