|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
স্বাদু সুতোর বুনোট
ঋজু বসু |
|
এক দিন যাকে ‘কেঁচো’ বলে কত অপমান করা হয়েছে, আজ তাকেই জিভের ডগায় বসিয়ে পুজো করছে আসমুদ্রহিমাচল!
বালিগঞ্জ প্লেসের চাউম্যান-এ বসে ফের এ কথা মনে এল। মেনুতে এক সঙ্গে আট-দশ কিসিমের নুডলস-এর ভিড়। কাকে ছেড়ে কাকে বাছি?
মেনল্যান্ড চায়না-র শেফ ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্যের কাছে চিনের নানজিয়াং শহরের একটি ঘরোয়া রেস্তোরাঁর গল্প শুনেছিলাম। বৃদ্ধ চাউমিন-শিল্পী সার্কাসের রিং ছুড়ে ছুড়ে খেলার কসরতে এক তাল ময়দা লোফালুফি করছেন। খেলতে খেলতেই একের পর এক চাউমিনের সব সুতো বার করে আনছেন তিনি। তার পরে অতিথি-নারায়ণের পছন্দসই সস, মাছটা-মাংসটার খোঁজ নিয়ে গল্প করতে করতেই দুরস্ত রান্না সেরে ফেলা হবে। পাতে-গরম পরিবেশন। চটজলদি লুচি বেলে গরম-গরম ভেজে দেওয়ার মতো এমন লাইভ নু্ড্ল্স শো কলকাতায় এখনও দেখা যায় না। কিন্তু বাঙালির প্রাণেও নুড্ল্স ক্রমেই নব নব রূপে আসছে। মেনল্যান্ড চায়না-র নিয়মিত সাপ্লায়ার এসে রোজ ভোর রাত থেকে ময়দা মেখে নুড্ল্স তৈরি করেন। গমের নুড্ল্স ছাড়াও চাল ও সবুজ মুগের ডালের নুড্ল্সও সেখানে মেলে।
রাবণ ও নুডলস-এর গুষ্টিতে আদতে খুব একটা ফারাক নেই। দুনিয়াময় ছড়ানো-ছিটোন নুড্ল্স পরিবারের সঙ্গে গান্ধারী-ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রেরও তুলনা করা চলে। হঠাৎ কৌরব ভায়াদের কথা ভাবতে বসলে কিন্তু দুর্যোধন, দুঃশাসনের পরে বড়জোর বিকর্ণকে মনে পড়বে। আমাদের চাউমিন-বিলাসও অনেকটা তেমনই, চেনা-জানাদের বৃত্তে ঘুরপাক খেয়ে মরে। ঝরঝরে শুকনো হাকা চাউমিন ও সাদাটে গ্রেভি-সিক্ত ক্যান্টনিজ চাউমিন ছাড়া ইতালির পাস্তা-স্প্যাগেতিও ক্রমশ আমাদের ঘরের লোক। কিন্তু এর বাইরেও ইদানীং নতুন নতুন স্বাদগন্ধ ঢুকে পড়ছে।
|
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
অঞ্জন দত্তের স্ত্রী ছন্দা সদয় হলে মাঝেমধ্যে তাঁদের বেনেপুকুরের বাড়ির উঠোনে এক রাত্তিরের পপ-আপ রেস্তোরাঁ বসে। কলকাতার সে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। ছন্দার সৃষ্টি ব্রহ্মদেশের খাউসোয়েতে ঠিক কী মেশে, তা এখনই সব মনে করে বলতে পারব না। কিন্তু থকথকে গ্রেভির নুড্লে রসুনকুচি, ডিমের হলদে, চিংড়ির শুঁটকি ইত্যাদি মিশে সে যে কী অপার্থিব রচনা, তা না খেলে বোঝানো যাবে না। কলকাতা শহরে এখন মালয়েশিয়ার লাক্সা সুপও মেলে। চিকেন-চিংড়ি মেশানো নারকোলের দুধের ঝাল-ঝাল নুড্ল্ সুপ খেলেও আরামে মুখ ছেড়ে যায়। ভাতের যেমন খিচুড়ি, বিরিয়ানি, পোলাও থেকে পান্তা সব কিছু ঘটতে পারে, দেশে দেশে রন্ধনশৈলী অনুসারে নুড্ল্সও তেমন পাল্টে পাল্টে যায়।
কলকাতার শিশু রেস্তোরাঁ চাউম্যানে ঢুকে মনে হয় এই নুড্ল্স নিয়ে আমরা কতটা পথ পেরিয়ে এসেছি। সম্ভবত ধর্মতলার চাংওয়া-য় তাঁর প্রথম চাউমিন-অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন সুরসিক প্রতাপ রায়। সেই পিচ্ছিল কেঁচোকে কাঁটা-চামচে সামলানোর অস্বস্তি শুনলে আজকের পাঁচ বছরের বাচ্চাও হাসবে। এই কলকাতায় বসে ক-ত বাঙালিই আজ চাউমিনকে খাস চপস্টিকে শাসন করছেন চাউম্যান-এ রাইস নুড্ল্ মিফুন বা চওড়াগোছের ফ্ল্যাট নুড্ল্ থেকে শুরু করে সাংহাই, ক্যান্টনিজ, সিঙ্গাপুরিয়ান নুড্ল্সও মিলবে। সিঙ্গাপুর-শৈলীর নুড্ল্সকে বাঙালির বিশেষ আপনার জন বলে মনে হবে। ঈষৎ হলুদগুঁড়ো খচিত এই সোনারঙা নুড্ল্স বরাবরই বাঙালি জিভে ভাল খাপ খায়। রানাঘাটের পরে যেমন তিব্বত, মেদ্নিপুরের পরেও তেমনই সিঙ্গাপুর (অশনি-সঙ্কেত স্মতর্ব্য) এ কথা তো বাঙালি কবেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
নুড্ল্স নিয়ে সব বাঙালিরই নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ খুব প্রখর। এখনও কেউ কেউ আছেন, মধ্য কলকাতায় চাংওয়া বা ইউ চু-র হ্যাংওভার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ওই তল্লাটে কলকাতার সাবেক চিনে-পাড়া এখন টিমটিম করছে। চাংওয়া-ও আর সেই চাংওয়া নেই। কিন্তু তাদের গ্রেভি চাউমিনের জাতটা আজও আলাদা। স্বাস্থ্যসচেতনদের চক্ষুশূল চর্বির তেল এই চাউমিনে মেশে কি না, জানি না। মিশলেও কিচ্ছু আসে যায় না। এই মিক্সড চাউমিনের ইউএসপি মেটের কষার টুকরো। পাশেই ভোজনরসিকদের প্রিয় পানশালা ডিউক-এর চাউমিনেও আগে মেটে পড়ত। সম্প্রতি মেটে নির্বাসিত। বড়ই বেদনাহত লাগে। আর ইউ চু-র সেরা রচনা জোসেফিন নুড্ল্স। হাল্কা গ্রেভিতে বিস্তর সব্জি, চিংড়ি, চিকেন, মাছে ভরপুর। মশলার আধিপত্য নেই। কিন্তু স্বাদে কারও থেকে খাটো নয়। ইউ চু-র কর্ত্রী জোসেফিনের নামেই পদটির নাম।
এই সাবেক চাউমিনের জমানা থেকে মেনল্যান্ড চায়না-র যুগে পৌঁছে আমাদের চাউমিন-অভিজ্ঞতাটাই পাল্টে গিয়েছে দেখি। তাজের চিনোয়াসেরির রন্ধন-শৈলীই অনেকটা সর্বজনীন হয়ে ওঠে মেনল্যান্ড চায়না-য়। আর রকমারি খাঁটি চিনে সসের অভিঘাতে সব রান্নার ভিড়ে নুড্ল্ তখন কিছুটা পার্শ্বচরিত্র। নতুন যুগের বাঙালি শিখেছে, মাছ-চিকেন-পর্কের প্রিয় চিনে পদগুলো উপভোগ করতে নিরাভরণ স্টিম্ড রাইস হলেই বেশি খুলবে। নুড্ল্স বা ফ্রায়েড রাইস না হলেও চলতে পারে। তবু মেনল্যান্ড চায়না-ও ঘুরে ফিরে নুড্ল্স উৎসব করে। হয়তো ফিনফিনে জাপানি সোবা নুড্লের সঙ্গে তখন দেখা হয়ে গেল।
ফ্ল্যাট নু্ড্ল্স এখনও বাঙালির তত প্রিয় নয়। কিন্তু চাউম্যানে বেশ চটপটা মুখরোচক ঢঙে রাঁধা হয়। লেবুপাতার সুঘ্রাণে তাই-স্টাইল নুড্ল্ও অনেকের মনে ধরে। সাংহাইয়ে কিছুটা অয়েস্টার সসের প্রাবল্য। বিরিয়ানির সঙ্গে কাবাবসেবনের মতো এ সব নুডলস-এর সঙ্গেও বেছেবুছে অর্ডার করতে হবে। আর গায়ে-হলুদ সিঙ্গাপুর নুডলস-এর সঙ্গে গ্রেভি-পদের থেকে শুকনো পদ বেশি ভাল জমবে। নুডলস-এর স্বাদটাও বেশি খুলবে। আর একান্তই কোনও গ্রেভি চাখতে হলে লবস্টার ইন চিলি ওয়াইন সস ফরমায়েশ করুন।
বিহারের সোনপুরের মেলা থেকে পাঁচতারার হেঁসেল সর্বত্র নুড্ল্স আমাদের জীবনের অঙ্গ। যস্মিন দেশে যদাচার মেনে সর্বত্র সে নিজেকে মানিয়েছে। বলাই যায়, বাঙালির ‘কেঁচো-সাধনা’ যাকে বলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বার করে ছেড়েছে। |
|
|
|
|
|