ব্যাগ গুছিয়ে...
স্বাদ দিয়ে যায় চেনা
গিলমোরের জাদু
যে ভাবে আইসক্রিম কাপে পদটি সাজিয়ে দেওয়া হল তাতে মনে হবে আস্ত একটা ডিম ডিপ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করা হয়েছে। তার গায়ে লেগে আছে বরফের টুকরো। চামচ দিয়ে টোকা দিয়ে ডিমের খোলায় আঘাত করলাম। একটা ছোট টুকরো বেরিয়ে এল। আর ভিতরে লাল টকটকে কুসুমটাকে তখনই চোখে পড়ল। তার চার দিকে সাদা অ্যালবুমিনের আস্তরণ। চামচ ডুবিয়ে ডিম কেটে মুখে দিলাম। জিভটা গিয়ে টাকরায় আঘাত করল। আহা!
অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগেই আমার এক বন্ধু একটি নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁর নাম করে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘সিডনি গেলে অবশ্যই ‘স্নো এগ’ খেও। একমেবাদ্বিতীয়ম।’’ অস্ট্রেলিয়ার বিমানে ওঠার সময়ে আমাদের সাত দিনের ঘোরাঘুরির যে নির্ঘণ্টটা পেলাম তাতে গন্তব্যের মধ্যে সিডনির ওই রোস্তারাঁর নাম ছিল। কী খাব তার তালিকায় ছিল সেই ‘স্নো এগ’। তাই জিনিসটা আসলে কী, খেতে কেমন তা নিয়ে আগ্রহ নিয়েই ঢুকেছিলাম ওই রেস্তোরাঁয়।
ভেবেছিলাম আস্ত ডিমটাকে কোনও ভাবে জমিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওই বহুচর্চিত খাবার। তাই ভাঙা খোল সরিয়ে রেখেছিলাম প্লেটের একধারে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে চলে এল রেসিপি। সেটা পড়ে নিজেকে বোকা বলে মনে হল। উপরের ওই খোলাটা ডিমের খোলাই নয়। তা তৈরি করা হয়েছে মল্টোজ দিয়ে। মল্টোজের আস্তরণের পিছনে যা তা আসলে ডিমের পোচ। বাড়িতে হামেশাই ডিমের পোচ কিংবা ওয়াটার পোচ খাই। এটা অন্য ধরনের পোচ। স্বাদটা ডিমের মতো। তবে বরফ-ঠান্ডা। আর মিষ্টি স্বাদ। মিষ্টি গন্ধটাও কেমন চেনা চেনা। গন্ধটা কীসের? হাতে ধরা রেসিপি বলছে, আতা আর পেয়ারার রসের মিশ্রণ। তারই গন্ধ।
অস্ট্রেলিয়ার পর্যটনের অঙ্গ হয়ে ওঠা এই ‘স্নো এগ’-এর উদ্ভাবক ওই রেস্তোরাঁরই মাস্টার শেফ পিটার গিলমোর। গিলমোরের নিজের পছন্দের একটা ডিশ এর আগেই আমরা খেয়েছি। সরু ফালি করা সাদা তাসমানিয়ান স্কুইড। সবুজ সসে তা ডোবানো। সঙ্গে গ্রিন স্যালাড। আমাদের গাইড ডোনা বলছিলেন, “তাসমানিয়া সমুদ্রের স্কুইডই সব থেকে সুস্বাদু। অস্ট্রেলিয়া থেকে এই স্কুইড পাড়ি দেয় আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলিতে। আর গিলমোরের গ্রিন স্যালাডটা একেবারেই তাঁর নিজস্ব।” স্নো এগের আগে ওই স্কুইড একেবারে যেন রাজযোটক।
তাঁর গ্রিন স্যালাডের নাম যে বিশ্বজোড়া তা ভালোই জানেন গিলমোর। কিন্তু এই গ্রিন স্যালাড তৈরির আসল রহস্যটা কী? রেস্তোরাঁয় আমাদের পাশে জমিয়ে বসলেন অস্ট্রেলিয়ার সব থেকে নামী শেফ। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “আসলে যে সব শাক-সব্জি দিয়ে স্যালাডটা আমি তৈরি করি সেগুলি প্রথমে আমি আমার বাড়ির পিছনে নিজে ফলাই। জাপানি মুলোর আকৃতিটা কেমন হবে, পেঁয়াজের রঙটা কেমন হবে, আলু ঠিক কখন তুলতে হবে সেটা আমিই ঠিক করি। বলতে পারেন, গবেষণা করি।” এখানেই শেষ নয়। গিলমোর বলেন, “একটি বা দু’টি গ্রামের কৃষককে ডেকে কী ভাবে ওই সব্জি ফলাতে হবে তা বুঝিয়ে দিই। ওরা সারা বছর শুধু আমার জন্যই ওই সব্জিগুলি ফলায়। বলতে পারেন এটাই আমার সাফল্যের গোপন কথা।”
সিডনি খাঁড়ির মুখে ওই রেস্তোরাঁয় গিলমোরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আর ল্যাম্ব, টুনা মাছ, কাঁকড়ার তিনটি পদ আয়েস করে খেতে খেতে কোথা দিয়ে যে তিন ঘণ্টা কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। গিলমোরের টানে ওই রেস্তোরাঁর মূল গেটে তখন লাইন পড়ে গিয়েছে।

এ তো আমাদের ভেটকি
অস্ট্রেলিয়ার একেবারে উত্তর প্রান্তের শহর মসম্যান। ওই শহরের কাছ দিয়েই বইছে ডেইনট্রি নদী। উত্তর কুইন্সল্যান্ডের এই নদী কুমিরের বাসস্থান হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। শুধু কুমিরই নয়। খাদ্যরসিকদের কাছে ওই নদীর গুরুত্ব অন্য কারণে। এই নদীতে পাওয়া যায় সুস্বাদু একটি মাছ। নাম তার বারামুন্ডি।
কেইর্নসে পা দিয়েই যে রেস্তোরাঁয় আমাদের খাওয়া জুটেছিল সেখানেই প্রথম বারামুন্ডির নামটা শুনি। মেনু তালিকায় স্যামন ছিল। কিন্তু নামটা নতুন নাম দেখে অর্ডার দিলাম, ‘বারামুন্ডি’। বড় একটা প্লেটে শাকসব্জির উপরে এল একটা বড় মাছের পিস। কাঁটা-চামচ চালাতেই মাখনের মতো কেটে গেল মাছ। মুখে দিয়ে স্বাদটা বড় চেনা চেনা মনে হল। একেবারে আমাদের ভেটকি মাছের মতো। তবে রান্নার গুণে মাছটা আরও নরম হয়েছে। মুখে দিতেই গলে গিয়েছে। মাছটা কোথা থেকে এল? আমাদের গাইড রোজালিন জানালেন, “ওটা ডেইনট্রি নদীর ফসল। অন্য নদীতে এই প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও ডেইনট্রির বারামুন্ডির কোনও তুলনা হয় না।”
রোজালিন লোভ দেখালেন, “দু’দিন পরে আমরা যাব মসম্যান। সেখানে ডেইনট্রি নদী থেকে ধরা টাটকা বারামুন্ডি খাওয়া যাবে! ওর স্বাদই আলাদা।” যথাসময়ে মসম্যানে পৌঁছলাম। একটি অতিথিশালায় আমাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা হল। সেখানে স্পেশাল মেনু হিসেবে পাতে এল বেকড বারামুন্ডি। সঙ্গে সেদ্ধ আলু। নানা ধরনের সস পাশে রাখা ছিল। কিন্তু মাছের যা স্বাদ তাতে সস আর কাজেই লাগল না। বেকড ভেটকির সঙ্গে তার কোনও পার্থক্যই নেই। ভেটকির সঙ্গে সব মিলে যাচ্ছিল। তাই জ্যান্ত মাছটা দেখতে কেমন সেই কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছিল। ওই অতিথিশালার কর্মীরাই বারামুন্ডির ছবি দেখালেন। একেবারে চেনা মাছ ভেটকির মতো। হোটেলে ফিরে ইন্টারনেটে বারামুন্ডি সার্চ দিলাম। দেখলাম আমার ধারণাই ঠিক। ওটা আমাদের ভেটকি মাছই।
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর ভাগে যে সব আদিবাসী (অ্যাবরিজিন্যাল) মানুষের বাস সেখানকার নদীর মাছ এই বারামুন্ডি। বারামুন্ডি কথার অর্থ বড় আঁশওয়ালা নদীর মাছ। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের ভেটকির এমন কদর দেখে আমি কিন্তু অভিভূত।
চৌবাচ্চায় ওরা কারা কেইর্নসের চিনা রেস্তোরাঁটায় ঢুকতেই চোখ আটকে গেল একটি বড় চৌবাচ্চায়।
হাল্কা গোলাপি শরীরটা। তার উপরে লাল ছিটে। মাথার সামনে লাল পুঁতির আকারের দুটি চোখ। চোখ দু’টি নড়ছে। কাচের বাইরে থেকে টোকা দিলাম। মাথার দুই পাশ থেকে বেরিয়ে এল দু’টি বিশাল দাঁড়া। সামনেটা কালো। বিশাল শরীরটা নিয়ে প্রাণীটা চৌবাচ্চার অন্য দিকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু আটকে গেল পিছনে থাকা ওর একটা জাত ভাইয়ের গায়ে। ওগুলি কাঁকড়া। যে সে কাঁকড়া নয়। নাম তাসমানিয়ান জায়েন্ট ক্র্যাব।
এক একটার ওজন সাড়ে আট থেকে ১০ কেজি। উপরের খোল প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার পুরু। সমুদ্রের বেশ গভীরে থাকে এই কাঁকড়া। চিংড়ি, স্কুইড এ সব এর খাদ্য। বিশ্বের সব থেকে বড় কাঁকড়াদের মধ্যে সব থেকে সুস্বাদু এই কাঁকড়া, এমনই দাবি চিনা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার লি-এর। ওঁর কথায়, “বিশাল কাঁকড়ার দাঁড়াটা দেখেছেন তো! এক বার যদি আপনার শরীরের কোথাও থাবা বসাতে পারে তা হলে সেখানকার মাংস খুবলে নেবে। আপনি কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারবেন না।” ওই চৌবাচ্চা থেকে তোলার পরে কাঁকড়ার যে পদটা তৈরি হয় তা কিন্তু মুখে দিলেই একেবারে তুলতুলে। মনেই হয় না ওটা ওই কাঁকড়ার মাংস।
পাশের চৌবাচ্চায় যে প্রাণীটি ছিল তার সামনের দাঁড়ার ছবি তোলার পরে ক্যামেরার ফ্রেমে আর কিছু ধরা পড়ে না। ওটা এক ধরনের লবস্টার (বড় চিংড়ি)। নাম তাসমানিয়ান রক লবস্টার। শুধু আপনার অর্ডারের অপেক্ষা। গোটা লবস্টারটাই বেক করে সস ও স্যালাড সহযোগে টেবলে পৌঁছে দিয়ে যাবে। বাঙালি পেট, কাঁকড়ার পরে ওই চিংড়ি আর পেটে সইবে না। তাই ঝুঁকি নিলাম মা। পাশের টেবিলে একটি অস্ট্রেলিয়ান পরিবার খাচ্ছিলেন। ওরা সেই লবস্টার নিলেন। আমি পাশ থেকে আড়চোখে দেখতে লাগলাম কেমন তারিয়ে তারিয়ে ওরা উপভোগ করছেন দৈত্যাকার প্রাণীটিকে।

ক্যাঙারু থেকে কুমির
কেইর্নসের সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁয় ঢুকে সবে চেয়ারে বসেছি ওয়েটার এসে হাজির। আগে থেকেই টেবল বুক করা ছিল। সৌজন্যে ট্যুরিজম অস্ট্রেলিয়া। কী কী আমরা খাব তার একটা ধারণাও আগে থেকে দেওয়া ছিল রেস্তোরাঁয়। হোয়াইট ওয়াইনের সঙ্গে প্রথমেই দু’টি পদ এল। একটি ঝিনুক। অন্যটা শামুক। দু’টির দু রকমের প্রিপারেশন। দু’টি ভিন্ন প্রকারের স্যালাডের সঙ্গে পরিবেশন করা হল সেগুলি। আমরা পাঁচ জন ছিলাম টেবলে। ঠিক হল বিভিন্ন পদ আমরা সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খাব। আর আমাদের খাবারের তালিকায় যে সব পদ থাকবে সেগুলি সবই অস্ট্রেলিয়াজাত।
আমাদের গাইড রোজালিন অর্ডার দিচ্ছিলেন। কানটা খাড়া করে রেখেছিলাম। উত্তর অস্ট্রেলিয়ার কেইর্নস বিখ্যাত তার কুমিরের জন্য। কুমিরের একটা পদ অর্ডার দেওয়া হল। ক্রক রক। চোখের সামনে কুমিরের বিচ্ছিরি চেহারাটা ফুটে উঠছিল। গোটা শরীরটা পুরু কাঁটা কাঁটা চামড়ায় ঢাকা। তাই শরীরের কোথায় দাঁত ফোটানো যাবে সেই নিয়ে চিন্তা ছিল। অর্ডার দেওয়া হল ক্যাঙারু স্যাটারে। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পশু ক্যাঙারু। তার মাংস কী করে খাব তা নিয়ে যুদ্ধ চলছিল মনের সঙ্গে। যাঁরা এর আগে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে গিয়েছেন তাঁদের মুখে শুনেছি মাংসটা নাকি দাঁতে ছেঁড়া যায় না।
নানা ধরনের মাছ ভাজা, কাঁকড়া আর চিংড়িতে মনোনিবেশ করেছিলাম। ভেবেছিলাম কুমির আর ক্যাঙারু একেবারে বাধ্য না হলে খাব না। পেটে যে আর জায়গা নেই তা বোঝানোর জন্য দু’একবার শব্দ করে ঢেকুর পর্যন্ত তুললাম। কিন্তু রোজালিন নাছোড়বান্দা। বললেন, “তোমাদের জন্য অর্ডার দিলাম। খেতেই হবে। দুটো পদ থেকে একটু করে খেয়েই দেখো। খারাপ লাগবে না।” রোজালিনের কথায় দু’টি পদ থেকেই একটু একটু করে কেটে খেলাম। কুমিরের পদটা মুখে দিতেই কিন্তু গলে গেল। দাঁত ব্যবহারের সুযোগ পেলাম না। স্বাদটাও মন্দ না। ঠিক করলাম ক্যাঙারু মুখে না রুচলে কুমিরটাই খাওয়া যাবে। কিন্তু ক্যাঙারুর মাংসটা চেখে দেখলাম তা ভেড়াকেও হার মানায়। পরের বার নিতে যাব দেখলাম ডিশ ফাঁকা। আমি দেরি করায় অন্যেরা চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে। আমার তখন অন্য চিন্তা শুরু হয়েছে। কচি পাঁঠার মতো আলু দিয়ে ক্যাঙারুর পাতলা ঝোল তৈরি করলে তা খেতে কেমন হবে!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.