ভোটে কর্নাটক
রাজত্ব হারিয়েও রাজা গড়ার যুদ্ধে তিনিই রাজা
ধুলোর মধ্যেও ঝাপসা হয়ে ফুটে উঠছে সেই চেনা হাসিটা।
হেলিকপ্টার মাটি ছুঁতেই কতকটা রজনীকান্তের স্টাইলে নেমে এলেন তিনি। বুকানাকেরে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা ইয়েদুরাপ্পা। গত পাঁচ বছর ধরে কর্নাটকের রাজনীতির যাবতীয় নাটকের রাজা। সঙ্গে ছায়াসঙ্গী শোভা করনলাজে। যাঁকে ‘ম্যাডাম’ বলেই ডাকেন অনেকে। তিনিও বিজেপি ছেড়ে ইয়েদুরাপ্পার নতুন দল ‘কর্নাটক জনতা পক্ষ’-তে। কর্নাটকের এ বারের ভোটযুদ্ধে ইয়েদুরাপ্পাই নতুন শক্তি। রাজত্ব নেই, তবু আজও নাটকের পট-পরিবর্তনের রশি তাঁর হাতে। নতুন দল গড়েও কর্নাটক নির্বাচনে নিজের টানটান আকর্ষণ ধরে রেখেছেন। ফারাক একটাই। পাঁচ বছর আগে বলতেন, বিজেপিকে জেতাও। এখন বলছেন, বিজেপিকে হারাও!
হেলিকপ্টার মাটি ছুঁতেই উন্মাদের মতো ভিড় ছেঁকে ধরল তাঁকে। সেই ভিড় সামলাতেই হয়রানি পুলিশের। তড়িঘড়ি গাড়িতে ঢুকে বসে গেলেন ‘ম্যাডাম’। কিন্তু ইয়েদুরাপ্পা? তিনি এখনও নরপতি। জানেন, ওই জনতার মাঝেই ক্ষমতার বীজ লুকিয়ে। গাড়ি ছেড়ে তাই হাঁটতে শুরু করলেন। সভাস্থল প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। সামনে ঢোল-নাকারা, জনতার জয়ধ্বনি। রাজা চলেছেন স্বপ্ন বিভোর হয়ে। ‘কিং’ না হোক, এ বারের ভোটে ‘কিং-মেকার’ হতেই হবে!
আধ ঘণ্টার বক্তৃতা। কন্নড় ভাষায় কী বললেন, বোঝার উপায় নেই। কিন্তু প্রতি দু’মিনিটে তালির ঝড়। আধ ঘণ্টায় অন্তত কুড়ি বার ‘বিজেপি’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন। তত বারই হাততালি! এই ভোটে তিনি বিজেপিকেই যে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে চান, তার আঁচ পাওয়া গেল কিছুক্ষণ পরেই। সভা শেষ হতেই ফের তুমুল ধাক্কাধাক্কি। এ বার গাড়িতে
ইয়েদুরাপ্পা
উঠবেন। আরও দু’টি সভা বাকি। তার ফাঁকেই বললাম, “ক’টা আসন পাবেন?” চোখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যয়ী হাসি। জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এঁদেরই জিজ্ঞাসা করুন না। আমাকে ছাড়া কেউ সরকার গড়তে পারবে?” ফের জয়ধ্বনি। চলেই যাচ্ছিলেন। আবার ফিরে এলেন। বললেন, “দিল্লিতে গিয়ে বিজেপি নেতাদের বলবেন, যে লোকায়ুক্ত রিপোর্টের জন্য ওরা আমাকে বাদ দিলেন, সেটি যেন ভাল করে পড়ে নেন! ওঁরা যদি পড়তে না পারেন, তা হলে আমি পড়ে বুঝিয়ে দেব।” ‘ম্যাডাম’কে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন ইয়েদুরাপ্পা।
আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভোট। ফলে তার মধ্যে লোকায়ুক্তের রিপোর্ট পড়ে পরিস্থিতি বদলানোর কিছু নেই। ইয়েদুরাপ্পা তেমন কোনও বার্তাও দিতে চাননি। শুধু এটুকুই বোঝাতে চেয়েছেন, যে বিজেপির লালকৃষ্ণ আডবাণী, অনন্ত কুমাররা তাঁকে ‘দলছাড়া’ করছেন, সেই বিজেপির বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করে তিনি ভোট লড়ছেন। লোকায়ুক্ত রিপোর্টে ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর আডবাণীই তাঁকে সরাতে সক্রিয় হয়েছিলেন। তার বদলা নিতে ইয়েদুরাপ্পা-ঘনিষ্ঠ নেতা ধনঞ্জয় কুমার সাংবাদিক বৈঠক করে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন এখানে। তাঁর বক্তব্য, ইয়েদুরাপ্পার গদি টিকিয়ে রাখার শর্তে বিপুল টাকা দাবি করেছিলেন আডবাণী ঘনিষ্ঠরা এবং ইয়েড্ডি সুটকেস বোঝাই করে সে টাকা তাঁদের দিয়েওছিলেন! সত্যি? ধনঞ্জয়কে ফোনে ধরায় বললেন, “যা বলেছি, ষোলো আনা খাঁটি। সময় এলে তার প্রমাণও দেব।”
পাঁচ বছর আগে কর্নাটকে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র নেতা হিসাবেই রাজার মুকুট উঠেছিল ইয়েদুরাপ্পার মাথায়। তাঁর শক্তিতেই দক্ষিণে প্রথম রাজ্য দখল করে বিজেপি। তাঁর এই রাজযোগের সাক্ষী ছিল তুমকুরের সিদ্ধগঙ্গা মঠ। জেডি (এস) নেতা কুমারস্বামী যখন তাঁর প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেন, তখন এই মঠ থেকেই ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ইয়েদুরাপ্পা। লিঙ্গায়েত সমাজকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে এই মঠ। দশ, বিশ, একশো, পাঁচশো...রুপোর থালিতে প্রণামী পড়ছে অনবরত। মঠের প্রধান স্বামী শিবকুমারের পা ছুঁয়ে দিনভর আশিস নিচ্ছেন অসংখ্য ভক্ত। স্বামীজি আপন মনে পড়ে চলেছেন টেবিলে রাখা কাগজ। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছেন। একশো ছ’বছর পার করেছেন। লিঙ্গায়েত সমাজের কাছে তিনি ‘সাক্ষাৎ ভগবান’। আর ইয়েদুরাপ্পা তাদের প্রতিনিধি। অন্তত এত দিন তাই-ই ছিলেন।
কিন্তু এ বার? আসলে ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে গত বছর। স্বয়ং সনিয়া গাঁধীকে যখন আলিঙ্গন করল এই মঠ। প্রায় দু’দশক আগে রাজ্যের লিঙ্গায়েত মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র পাটিলকে রাজীব গাঁধী সরানোর পর থেকে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় আর কংগ্রেসমুখী হয়নি। কিন্তু সনিয়াকে এক মঞ্চে নিয়ে অনুষ্ঠান করার পর লিঙ্গায়েত সমাজও ধন্ধে, তা হলে কি স্বামীজি এ বারে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার বার্তা দিচ্ছেন? শুধু কি তাই? যে কুমারস্বামী ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করায় ইয়েদুরাপ্পা এই মঠ থেকে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সেই কুমারস্বামীর ভাই এইচ ডি রাবানা সম্প্রতি আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন স্বামীজির পা ছুঁয়ে। মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টার নিজেও লিঙ্গায়েত। ইয়েদুরাপ্পা দল ছাড়ার পর তাঁকেই লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের ‘এক মাত্র’ নেতা হিসাবে তুলে ধরতে কোনও কসুর করেনি বিজেপি। তিনিও মঠের নিয়মিত অতিথি।
ফলে এ বারে ভোটযুদ্ধে রাজ্যের সবথেকে বড় সম্প্রদায় অনেকটাই বিভ্রান্ত, খণ্ড-বিখণ্ড। প্রভাবশালী মঠগুলিও তাই কোনও স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে না। সেই সুযোগে সব দলই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবু বিজেপি জানে, লিঙ্গায়েতের সিংহভাগ ভোট কাড়বেন ইয়েদুরাপ্পাই। নিজে বেশি আসন না পান, অন্তত বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসানোর কাজটি সারবেন। এক সময় ইয়েদুরাপ্পা ও ইশ্বরাপ্পা হাতে হাত মিলিয়ে শিমোগাতে বিজেপি দফতর বানিয়েছিলেন। এখন ইয়েদুরাপ্পা ও ইশ্বরাপ্পার সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। শিমোগা থেকে বিজেপির টিকিটে লড়ছেন ইশ্বরাপ্পা। আর পাশের কেন্দ্র শিকারিপুরা থেকে ইয়েদুরাপ্পা। নিজের জয় সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি ইশ্বরাপ্পার হারের স্বাদও এখন চাখতে চান ইয়েদুরাপ্পা। বিজেপির সেই দফতরটি এখন ইশ্বরাপ্পার কব্জায়। সেখানে বসেই তিনি বলছেন, “এই উন্নয়নের একক দাবিদার ইয়েদুরাপ্পা কী করে হন? বিজেপি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী না বানালে তিনি কি সেই কাজ করার সুযোগ পেতেন?”
এ বারের ভোটে বিজেপি যদি সরকার গড়তে না-ও পারে, তা হলেও লোকসভার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখতে চায় তারা। দলের রণকৌশলের দায়িত্বে থাকা অরুণ জেটলির মতে, “আমাদের লক্ষ্য যতটা সম্ভব আসন বাড়ানো ও আমাদের ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখা।’’ তলে তলে ইয়েদুরাপ্পাকে দলে ফেরানোর সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
উমা ভারতী তো এখানে প্রচারে এসে প্রকাশ্যেই আবেদন জানিয়েছেন ইয়েদুরাপ্পাকে, “বড় ভাই ভোটের আগেই যেন ‘কিং-মেকার’ হয়ে উঠেছেন ইয়েদুরাপ্পা নিজেই! তাই বিজেপির মূল নিশানা তিনিই। পুরনো দলের বিরুদ্ধে এ বারের যুদ্ধে কি জয় পাবেন লিঙ্গায়েত ‘স্ট্রংম্যান’?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.