ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির ব্যাপারে ন’মাস আগেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সতর্ক হতে বলেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর, সেবি-র চেয়ারম্যানরা। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তরফে সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি (পিএসি)-কে জানানো হয়েছে, গত বছর জুনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-সহ দেশের সব আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি বৈঠকে বসে। সাধারণ মানুষের থেকে বেআইনি ভাবে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্ত রুখতে রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশের আর্থিক অপরাধ শাখার সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি-র মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে। সে জন্য রাজ্য স্তরে এই সব সংস্থাকে নিয়ে যে সমন্বয় কমিটি রয়েছে, তার বৈঠক ঘনঘন ডাকার জন্য রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করে একটি চিঠিও পাঠানো হয়। অর্থ মন্ত্রকও সব রাজ্যকে এ নিয়ে চিঠি পাঠায়।
সারদা-কাণ্ডের পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে বারবার দাবি করা হয়েছে, ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির কাজকর্মের বিষয়ে রাজ্যকে কিছুই জানায়নি কেন্দ্র। সেই দাবি ভুল প্রমাণ করতে এ বার পিএসি-কে দেওয়া অর্থ মন্ত্রকের নোটকে হাতিয়ার করছে সিপিএম। দলের রাজ্যসভার সদস্য প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে পিএসি-র চেয়ারম্যান মুরলীমনোহর জোশীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। জোশী সেই অভিযোগ পাঠিয়ে দেন অর্থ মন্ত্রকের কাছে। এ বার অর্থ মন্ত্রক তার জবাব দিয়েছে। সিপিএম নেতারা অর্থ মন্ত্রকের এই চিঠিকে হাতিয়ার করেই সংসদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সরব হতে চাইছেন। সারদা-কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের দাবিতেও এই চিঠিই বড় অস্ত্র তাদের।
চিঠিতে কী বলেছে অর্থ মন্ত্রক?
মন্ত্রকের তরফে পিএসি-কে জানানো হয়েছে, ১ এপ্রিল পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ২৬টি সংস্থার বিরুদ্ধে সেবি ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ছাড়াও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদালতে এই ধরনের সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ৫৮টি মামলা চালাচ্ছে সেবি। একটি মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। অর্থ বিষয়ক দফতরের মূলধনী বাজার শাখার সহ-অধিকর্তা জয়পাল শর্মা ১৪ এপ্রিল পিএসি-কে জানিয়েছেন, গত বছরের ১৪ জুন হায়দরাবাদে আর্থিক স্থায়িত্ব উন্নয়ন পরিষদের বৈঠক হয়। সেখানে ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডি সুব্বারাও, সেবি-র চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহা, বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইআরডিএ-র চেয়ারম্যান ডি হরিনারায়ণ, পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান যোগেশ অগ্রবাল-সহ অনেকে। ওই বৈঠকে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে আলোচনায় দেখা যায়, রাজ্যের সঙ্গে এই সংস্থাগুলির সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এর পরেই আর্থিক পরিষেবা দফতরের তরফে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সব রাজ্যকে চিঠি লেখা হয়।
অর্থ মন্ত্রকের তরফে পিএসি-কে জানানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই ওই চিঠি পাঠানো হয়। প্রশান্তবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, উনি কিছু দিন আগে সারদা গোষ্ঠীর কাজকর্ম সম্পর্কে জেনেছেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের চিঠি থেকে স্পষ্ট, ন’মাস আগেই তাঁর সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। সারদা-র মতো বহু সংস্থার বিরুদ্ধে যে সেবি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনেক আগে থেকে তৎপর হয়েছিল, তা-ও ওই চিঠিতে রয়েছে।” প্রশান্তবাবু বলেন, “অসংখ্য মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। রাজ্যের পাশাপাশি কেন্দ্রেরও দায়িত্ব এঁদের সুরাহা দেওয়া।”
কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী সচিন পায়লট আজ জানিয়েছেন, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সাহায্য করতে চান। পায়লট বলেন, “আমাদের এখন লক্ষ্য হল, পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লগ্নিকারীরা যাতে তাঁদের আমানত ফেরত পান, তা দেখা এবং এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সাহায্য করা।” কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর যুক্তি, সংসদের চলতি অধিবেশনে কোম্পানি বিল পাশ করানো গেলে এ সব ক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধা হবে। কারণ কোম্পানি বিলে ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির প্রতারণা রুখতে আরও স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান আইনে যে সব ফাঁকফোকর রয়েছে, সেগুলিকেই কাজে লাগাচ্ছে ভুঁইফোড় সংস্থাগুলি। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, এ জন্য সেবি-র ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ১৯৭৮ সালের প্রাইজ চিট ও মানি সার্কুলেশন (ব্যানিং) আইনটিকেও মজবুত করার প্রস্তাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
|