বাইরের চেহারা যা, সেটা আসলে মুখোশ। ভিতরের মুখটা সম্পূর্ণ আলাদা!
সংবাদপত্রের নতুন সংস্করণ চালু করার নামে সারদা-প্রধান সুদীপ্ত সেন বিভিন্ন রাজ্যে ১৭টি অফিস খুলেছিলেন। কিন্তু সংবাদ প্রকাশনা ছিল গৌণ, সেখান থেকে লগ্নির কারবার ছড়িয়ে দেওয়াই সুদীপ্তবাবুর মূল লক্ষ্য ছিল বলে বিধাননগর পুলিশের তদন্তকারীদের দাবি। এর বাইরেও কোথাও কোথাও আবার অফিস না-খুলে শুধু নিজস্ব সংবাদপত্রের জন্য কর্মী নিয়োগ করেছিল সারদা গোষ্ঠী। তদন্তকারীদের অনুমান, এর পিছনেও টাকা তোলার উদ্দেশ্যই ছিল মুখ্য।
এ বার প্রয়োজনে ওই সব কর্মীদের চিহ্নিত করে তাঁদের কাউকে কাউকে জেরার কথা ভাবছে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, লগ্নি-জাল বিস্তারের লক্ষ্যে সারদা গোষ্ঠী ‘ওভারল্যান্ড মডেল’ হাতিয়ার করতে চেয়েছিল বলে সুদীপ্তবাবু জেরায় জানিয়েছেন। সেটা কী?
গোয়েন্দা-সূত্রের ব্যাখ্যা: লগ্নিসংস্থা ওভারল্যান্ড নিজেদের আর্থিক কারবার ছড়ানোর জন্য সংবাদপত্রকে বেছে নিয়েছিল। নিজস্ব সংবাদপত্রে তারা জেলাস্তরের খবরকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে লগ্নির ব্যবসাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের তৃণমূলস্তরে। তাদের দেখানো পথেই সুদীপ্তবাবু হাঁটতে শুরু করেছিলেন।
এবং এই উদ্দেশ্যসাধনের স্বার্থে অর্থলগ্নির কারবারের সঙ্গে সাংবাদিকতাকে তিনি এক করে দিতে চেয়েছিলেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। “সেন স্যার চাইছিলেন, তাঁর কাগজের জেলা-সাংবাদিক একাধারে খবর জোগাড় করবেন, আবার সারদার এজেন্ট হয়ে মানুষের থেকে টাকাও তুলবেন।” জানান সংস্থার এক কর্মী। ওঁদের অনেকের মত, দু’বছরে সংস্থায় নতুন টাকার জোগান কমেছিল। বহু জায়গায় এজেন্টরা ধোঁকা দিয়ে নিজস্ব সংস্থা গড়ে টাকা তুলতে শুরু করেন। এই সমস্যার মোকাবিলা করতেই সাংবাদিকতাকে লগ্নির ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা।
সারদার কর্মচারীদের মুখে পুলিশ এ-ও জানতে পেরেছে, জেলাস্তরের সংবাদপত্রকর্মী নিয়োগের জন্য মার্চে সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে তিন দিন ইন্টারভিউ হয়।
এক কর্মী বলেন, “ইন্টারভিউয়ে প্রার্থীদের বলা হয়েছিল, দু’শো জন মোটা অঙ্কের লগ্নিকারী জোগাড় করতে পারলেই সারদার কাগজে জেলা সাংবাদিকের চাকরি পাকা।” তাঁর ব্যাখ্যা, “স্যার ভেবেছিলেন, এতে দু’দিক দিয়ে লাভ হবে। প্রথমত, সাংবাদিক নিজেই এজেন্ট হিসেবে কাজ করলে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকের সঙ্গে জেলার পুলিশ-প্রশাসনের যোগাযোগের সুবাদে টাকা তোলার কাজ নির্বিঘ্নে হবে।” কলকাতায় নগদ টাকা চালানের সময়ে ‘প্রেস’ স্টিকার লাগানো গাড়িগুলো ব্যবহারের কথাও সুদীপ্তবাবুর মাথায় ছিল বলে তাঁর কর্মী মহলের খবর। তদন্তকারীরা এখন জানতে চান, সারদা-কর্তা জেলাস্তরে ঠিক কী ভাবে জাল বিছাতে চেয়েছিলেন। মুম্বইয়ে বা ত্রিপুরা-ছত্তীসগঢ়-ওড়িশা-বিহারে দফতর খোলার পিছনে তাঁর আরও কী উদ্দেশ্য ছিল, সেটা জানার চেষ্টা চলছে। পুরো চক্রের আন্দাজ পেতে ওই সব রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দারা। রাজ্যে লগ্নি-প্রকল্পে গ্রাহক জোগাড় করতে সারদা কত ‘বৈচিত্র্যের’ সঙ্গে জাল বিছিয়েছিল, তার একটা আন্দাজ তদন্তকারীরা পেয়ে গিয়েছেন।
কী রকম? গোয়েন্দাদের দাবি: এজেন্টরা তো বটেই, ডাকঘরে-ডাকঘরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন সারদার ‘কাউন্সেলরেরাও।’ যাঁদের কাজ ছিল, পোস্ট অফিসে বিভিন্ন সঞ্চয়-প্রকল্পে টাকা জমা দিতে আসা মানুষকে ‘বোঝানো।’ মানুষকে বিশদে বলা হতো, পোস্ট অফিসের বদলে সারদার প্রকল্পে টাকা রাখলে কত বেশি লাভ, বাড়তি সুবিধাই বা কত। প্রয়োজনে লগ্নিকারীদের বাড়িতেও পৌঁছে যেতেন তাঁরা। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “সুদীপ্তবাবুর মনে হয়েছিল, সাধারণ এজেন্টরা শিক্ষিতদের অনেক কিছু বোঝাতে পারছেন না। তাই সমাজের তথাকথিত উপর মহলে জাল ছড়ানোর লক্ষ্যে শিক্ষিত ও বলিয়ে-কইয়ে ছেলে-মেয়েদের কাউন্সেলর হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল।”
বহু ক্ষেত্রে ফলও মিলতে শুরু করে। নিম্নবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারদার বাহু বিস্তৃত হয় অভিজাত সমাজের অন্দরে। বেশ কিছু চিকিৎসক, শিক্ষক, এমনকী ব্যাঙ্ক-অফিসারও এ ভাবে সারদার ফাঁদে পা দেন।
তবে ‘বোঝাতে’ গিয়ে কখনও কখনও ফ্যাসাদেও পড়তে হয়েছে। যেমন হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক ডাকঘরে। সংস্থার এক পদস্থ আধিকারিক জানাচ্ছেন, ওখানে পুলিশের খপ্পরে পড়েছিলেন এক কাউন্সেলর। এক বৃদ্ধার অভিযোগ ছিল, সারদায় টাকা ঢালার জন্য ওই ব্যক্তি তাঁকে টানা কয়েক মাস ধরে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। অভিযুক্ত কাউন্সেলর শেষমেশ ক্ষমা চেয়ে সে যাত্রা কোনও মতে রেহাই পান। |