হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। কিন্তু পর্বতের মূষিক প্রসবের মতোই আয়ের বহর কয়েক লক্ষ টাকা। সারদা গোষ্ঠী কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন করত, কিন্তু খাতায় কলমে আয়ের দেখাত সামান্য। ওই আয়ের উপরও যে-কর হত, তা-ও তারা দিত না। সারদা কাণ্ডের তদন্তে নেমে এমনই তথ্য পেয়েছেন আয়কর অফিসারেরা। যার সঙ্গে মিলে গিয়েছে সুদীপ্তকে জেরা করে পুলিশের পাওয়া তথ্য-ও।
পুলিশ সূত্রের খবর, সারদার ব্যবসায় গত দু’বছর কোনও অডিট হয়নি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন শাখায় হিসেবে রাখার ক্যাশবুকও রাখতেন না সারদা কর্তৃপক্ষ। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ সোমবার বলেন, “সারদার যে শাখা অফিসগুলো ছিল সেই শাখা অফিসে ক্যাশবুকই ছিল না। এমনকী, কম্পিউটারেও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কোনও হিসাব রাখা হত না।” এর ফলে খুব সহজেই লক্ষ লক্ষ টাকা আর্থিক তছরুপও সম্ভব বলে পুলিশের দাবি।
আয়কর দফতর সূত্রের খবর, ২০০৯-’১০ আর্থিক বছরে সারদা গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান সংস্থা সারদা রিয়্যালটিজের আয়করের হিসাব হয়েছিল ১৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু ওই টাকা তারা মেটায়নি। ২০১০-’১১ সালে সারদা রিয়্যালটিজের নিজেদের হিসাব অনুযায়ীই আয়করের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৮ লক্ষ টাকা। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২০ লক্ষ টাকা তারা দিয়েছে। ২০১১-’১২ সালে তারা আয়কর রিটার্নই জমা দেয়নি।
এ ছাড়া বহু ক্ষেত্রেই এজেন্টদের যে-কমিশন দেওয়া হত, তার থেকে টিডিএস কাটা হত না বলেও আয়কর দফতর সূত্রের খবর। একই ভাবে কাটা হত না ম্যাচিওরিটি বা মেয়াদপূর্তির পর প্রাপ্য টাকার উপর টিডিএসও। কমিশনের পরিমাণ আয়কর দফতরের কাছে গোপন রাখার পাশাপাশি এজেন্টদের হাতে বেশি টাকা তুলে দেওয়ার জন্যই সারদা কর্তৃপক্ষ এটা করতেন বলে আয়কর অফিসারদের ইঙ্গিত। তাঁরা বলছেন, কিন্তু ফেরত দেওয়ার দায় থাকলেও ব্যবসায় লগ্নি করে খাতায়-কলমে আয় দেখানোর ব্যাপারে তারা খুব আগ্রহী ছিল না।
একই তথ্য উঠে এসেছে পুলিশি তদন্তে-ও। অর্ণববাবু জানান, কোন শাখায় কত লেনদেন হতো এবং সেখান থেকে কত টাকা তছরুপ হয়েছে সেই ব্যপারে এখন খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এই জন্য বিধাননগর পুলিশের একটা আলাদা সেল তৈরি করা হয়েছে। শুধু শাখা অফিসেই আর্থিক তছরুপ নয় সল্টলেকের মিডল্যান্ড পার্কে সারদার প্রধান কার্যালয়ে আর্থিক তছরুপ কতটা হচ্ছিল তা-ও পরীক্ষা করে দেখছেন গোয়েন্দারা।
রবিবার সকালে মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে তল্লাশি চালায় পুলিশ। বাজেয়াপ্ত করে সিডি, কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক-সহ নথিপত্র। পুলিশ জানিয়েছে, কর্মীদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাটা হলেও তা সরকারি কোষে ঠিক মতো দেওয়া হতো কি না, তা জানতে ওই নথিপত্র যাচাই করে দেখা হচ্ছে। বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রের খবর, সারদায় মোট ২৫০০ কর্মী কাজ করতেন। তাঁদের বেতনের জন্য নির্ধারিত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও ‘পে-স্লিপ’-ও পরীক্ষা করা হচ্ছে।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, সারদার সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই ছিল সুদীপ্ত সেনের নামে। এবং সেগুলি বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কের। সংস্থার কোনও ডিরেক্টরের নামে অ্যাকাউন্ট ছিল না। সুদীপ্তবাবু টাকা পয়সার ক্ষেত্রে কার্যত কাউকেই বিশ্বাস করতে না। এখনও পর্যন্ত দু’শোরও বেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিস পেয়েছে পুলিশ।
তদন্তকারীদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, দিল্লিতেও সারদার বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট মিলেছে। জেরায় জানা গিয়েছে, দিল্লিতে নতুন নতুন শাখা অফিস খোলার ব্যপারে জোর দেওয়া হয়েছিল দিল্লিতে। সেখানের পুরো কাজের দায়িত্ব ছিল সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া অরবিন্দ সিংহ চৌহানের উপরে। দিল্লিতে সারদা গোষ্ঠীর ব্যবসা ভাল না হওয়ায় অরবিন্দকে বকাবকিও করেছিলেন সারদা কর্তা। তদন্তকারীদের অনুমান, উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা ছড়ানোর উদ্দেশেই দিল্লি অফিসের উপরে জোর দিতে চেয়েছিল সারদা। |