মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর বিরুদ্ধে সিপিএম নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণের মোকাবিলায় আইনি পথে হাঁটল তৃণমূল। আর রাজনৈতিক মোকাবিলার লক্ষ্যে পাল্টা প্রচারে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। সারদা-কাণ্ডে তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের জড়িয়ে যে প্রচার বিরোধীরা করছে, তার জবাব দিতে চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে শ্যামবাজার এবং পানিহাটিতে সভা করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
রবিবার উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে দলীয় সভায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবসায়িক কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তৃণমূলের পক্ষ থেকে গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বুদ্ধ-গৌতমের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “অভিষেক উচ্চশিক্ষিত। এমবিএ পাশ করেছেন। তাঁকে সামনে রেখে সিপিএমের কিছু বাতিল নেতা মিথ্যাচার করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়েছে।” অভিষেক নিজে সংবাধমাধ্যমের কাছে মুখ না-খুললেও, তৃণমূলের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, ‘আমাদের যুব শাখা তৃণমূল যুবার সভাপতি তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা একটি জনসভায় পুরোপুরি কল্পিত এবং কুৎসামূলক অভিযোগ করেছেন। |
সাংবাদিক বৈঠকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মহাসচিব, তৃণমূল কংগ্রেস।— নিজস্ব চিত্র। |
‘অভিযোগ হল, অভিষেকের সংস্থা চিট ফান্ডে জড়িত এবং তারা ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। এই অভিযোগ হাস্যকর এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা। সিপিএম ওই অভিযোগের সপক্ষে এক বিন্দু প্রমাণও দেয়নি। আমরা সিপিএম দল এবং তাদের নেতাদের আহ্বান জানাচ্ছি তাঁরা ওই সংস্থার (মোটেই চিট ফান্ড ব্যবসায় জড়িত নয়) নথিপত্র খুঁটিয়ে দেখে ৩০০ কোটি দূর অস্ত্, ৩০০ টাকার দুর্নীতি বার করুন!’ ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থার সঙ্গে তৃণমূলের সরকার একাকার হয়ে গিয়েছে বলে পানিহাটির সভায় বুদ্ধবাবু, গৌতমবাবুরা অভিযোগ করেছিলেন। এ দিন সিপিএমের প্রকাশনা সংস্থার টেলিফোন নির্দেশিকায় সারদা-সহ একাধিক ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে পার্থবাবু প্রশ্ন তোলেন, “এই বিজ্ঞাপন কাদের?” তিনি প্রশ্ন তোলেন, ২০১০ সালে ফিল্মোৎসবের খরচের টাকা কে দিয়েছিল? এ নিয়ে তদন্ত দাবি করেন পার্থবাবু। পানিহাটিতে গৌতমবাবুর বক্তব্যের সমালোচনা করে পার্থবাবু বলেন, “আমরা মানহানির মামলা করছি। যাঁরা বলেছেন, যাঁরা সেই বক্তব্য ছেপেছেন, কেউই বাদ যাবেন না।”
|
“অভিষেক উচ্চশিক্ষিত। এমবিএ পাশ করেছেন। তাঁকে সামনে রেখে সিপিএমের কিছু বাতিল নেতা মিথ্যাচার করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়েছে।”
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মহাসচিব, তৃণমূল কংগ্রেস
|
|
পার্থবাবুর বক্তব্য ছাড়াও, এ দিন দলীয় ওয়েবসাইটে বলা হয়, ‘তৃণমূল জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত বিষয়েই রাজনীতি করায় বিশ্বাস করে। বিরোধী পক্ষের নীতি-আদর্শ ভুল মনে
হলে আমরা সেগুলিকে আক্রমণ করি। কিন্তু আমরা বানানো অভিযোগ তুলি না, বা রাজনীতিকদের পরিবারের লোকজনকে দলাদলিতে জড়াই না। সিপিএম এবং তাদের এক প্রাক্তন মন্ত্রী যা করেছেন, তা এক জন নির্দোষ মানুষের মানহানির সমান। তাঁরা শীঘ্রই আমাদের আইনজীবীর কাছ থেকে চিঠি পাবেন।’ ওয়েবসাইটে ঘোষণা ছাড়াও, তৃণমূলের পক্ষে দলের আইনজীবী সেলের নেতা রাজদীপ মজুমদার জানান, পানিহাটি জনসভায় গৌতমবাবু যে মন্তব্য করেছেন, সে জন্য তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। নোটিস পাওয়ার পরে তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ্যে ক্ষমা না-চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও কালো টাকা নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
গৌতমবাবু এ দিন সন্ধ্যায় বলেন, “আমি মমতার ভাইপোর আইনজীবীর চিঠি পেয়েছি। ওঁরা বিষয়টিকে আদালতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। যাতে বিষয়টি বিচারাধীন বলে আমাদের মুখ বন্ধ করা যায়। কিন্তু এ ভাবে মুখ বন্ধ করা যাবে না। আমাদের আইনজীবী ওই চিঠির জবাব দেবেন।”
আইনি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীদের রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার কর্মসূচিও তৃণমূল নেতৃত্ব নিয়েছেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তৃণমূল নেত্রী সামনের শুক্রবার দুপুরে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলের সাধারণ পরিষদের সভা ডেকেছেন। তবে তার আগেই ২ মে, বৃহস্পতিবার শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে জনসভায় বক্তৃতা করবেন মমতা। পার্থবাবু জানান, রাজ্যে উন্নয়নের কাজে যাঁরা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে মানুষকে সজাগ ও সতর্ক করবেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। শনিবার ৪ মে পানিহাটিতে যেখানে গৌতমবাবুরা সভা করে ‘মিথ্যাচার’ করেছেন, সেখানেই সমাবেশ করবে তৃণমূল। সেই সমাবেশেও মুখ্য বক্তা মমতা।
মমতার পথে নামার কর্মসূচি নিয়ে বলতে গিয়ে পার্থবাবু, দলের রাজ্য সভাপতি ও সাংসদ সুব্রত বক্সীর ব্যাখ্যা, “আমাদের নেত্রী সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন। আমরা সেই ভাবেই দলের কাজ করতে অভ্যস্ত।”
তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনকালের দুর্নীতি ও অনুন্নয়নের ছবি সরিয়ে মমতা-সরকারের দু’বছরের উন্নয়নের কাজকে খাটো করার চেষ্টা চলছে। পানিহাটিতে সিপিএমের সভা থেকে মমতা ও তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে যে সব অভিযোগ গৌতমবাবুরা করেছেন তার তীব্র সমালোচনা করে তৃণমূলের ওয়েবসাইটে এ দিন বলা হয়েছে, ‘আমরা এই প্রকাশ্য কুৎসা এবং কাদা ছোড়াছুড়ির নিন্দা করছি। যদিও এতে আমরা অবাক হইনি। সিপিএম জানে, রাজ্য সরকারের নতুন চিট ফান্ড আইন এবং সারদা-কাণ্ডের তদন্তে তাদের অনেক বর্ষীয়ান সদস্যের ভূমিকা জানাজানি হয়ে যাবে এবং তার ফলে দল যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়বে। সে জন্যই তারা আতঙ্কিত। তাই কমিউনিস্টরা এ ভাবে চরিত্র হনন করে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করছেন।’
তবে পানিহাটিতে তৃণমূলের পাল্টা সভার কর্মসূচিকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি গৌতমবাবু। বলেন, “মমতা ভয় পেয়েছেন বলেই পানিহাটিতে পাল্টা সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা করুন। কিন্তু মানুষ আর ওঁর কথা আর বিশ্বাস করছে না। ক’দিনের মধ্যেই আমি আবার মুখ খুলব। আরও তথ্য ফাঁস করব। তৃণমূলের নেতাদের কাছে এত কোটি কোটি টাকা কথা থেকে এসেছে তার জবাব চাই।”
তবে গৌতমবাবুদের বক্তব্যকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে পার্থবাবু সাফ বলে দেন, “এরা ভরপেট খেয়ে এখন মিথ্যা কথা বলছেন। ওঁরা যা বলেছেন কোনও সুস্থ মানুষ তা বলতে পারেন না।” বাংলার মানুষ যে এখনও তৃণমূল নেত্রীর উপর ভরসা রাখেন তা জানিয়ে দলের মহাসচিব বলেন, “শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, মমতাই মানুষের ভরসা।”
|