ভুঁইফোঁড়ের বিরুদ্ধে সরব শুভেন্দু
নিশানা মুখ্যমন্ত্রী, ভাইপোকে জড়ালেন গৌতম
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তোপ দেগে যে দিন আমানতকারীদের সব টাকা তুলে নিতে বললেন তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী, ঘটনাচক্রে সে দিনই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে এই কেলেঙ্কারিতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারকে জড়িয়ে দিলেন সিপিএম নেতা গৌতম দেব।
গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে এই ধরনের ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির সম্পর্ক নিয়ে নিয়মিত সরব প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতমবাবু। কিন্তু সারদা-কাণ্ডকে সামনে রেখে এ বার যে অভিযোগ তিনি প্রকাশ্যে এনেছেন, তা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর। যা বিতর্কে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো এবং তৃণমূল ‘যুবা’র সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবসায়িক কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশিই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন, “সিবিআই তদন্তে ভয় কী? সিবিআই তদন্ত না-করে পারবেন না! যতই ভাল অফিসার থাকুক, বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের পক্ষে এত বড় ঘটনার তদন্ত করা সম্ভব নয়।”
কাগজ হাতে অভিযোগ। পানিহাটির দলীয় সভায় গৌতম দেব। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
পানিহাটিতে রবিবার সিপিএমের সমাবেশে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মঞ্চে বসিয়েই দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু প্রশ্ন তোলেন ‘পয়লা বৈশাখের আগে আমি কিছু জানতাম না’ মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের বাস্তব ভিত্তি নিয়ে। একটি সংস্থার নাম করে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশেই তাঁর প্রশ্ন, “এই সংস্থাটি কার? গত দু-তিন বছরে তারা প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা চালাচ্ছে। সংস্থা চালায় কে? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়! নির্মাণ ব্যবসা থেকে সব কিছুই করে। তিনিই আবার তৃণমূল ‘যুবা’র সভাপতি।” গৌতমবাবুর অভিযোগ, “ওটা মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি। যেগুলোকে আমরা চিটফান্ড বলি, সেগুলো সবই এই রকম নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি)। এটাও (ওই সংস্থা) চিটফান্ড কি না, আশা করি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জবাব দেবেন! দু’বছরে এত কোটি টাকার সম্পত্তি করেছে। নির্মাণ ব্যবসা করছে, ফ্ল্যাট করছে, কনসালটেন্সি করছে, সারা দেশে ছুটে যাচ্ছে! আপনি জানেন? এই সংস্থা কার অনুমোদিত? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি কার?”
এই সঙ্গেই গৌতমবাবুর কটাক্ষ, “যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো এই রকম কোম্পানি চালায়, তা হলে সুদীপ্ত সেনকে কী ধরবেন! চিটফান্ডের কোলে মমতা দোলে লোকে এই রকম বললে কী বলবেন?” একই মঞ্চ থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর অভিযোগ, “গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই ঘটনাটা ঘটছে। দু’বছর ধরে এই ধরনের সব ক’টা সংস্থাকে এঁরা (তৃণমূল) চুটিয়ে উৎসাহিত করেছেন। এখন হঠাৎ বিপদে পড়ে বলছেন, না, না, না! লোককে বাঁচাতে হবে, ওঁদের মনে হয়েছে!” নিজেদের জমানার তুলনা টেনে বুদ্ধবাবুর আরও মন্তব্য, “দশ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম। ধারেকাছে ঘেঁষতে দিইনি এই সব সংস্থাকে! বলতে পারবেন আমাদের কারও বিরুদ্ধে?” বাম জমানার প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের আমল থেকেই যে ভুঁইফোঁড় সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই ইতিহাসও স্মরণ করিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।



গৌতম দেব
গৌতমবাবুর এমন গুরুতর অভিযোগের পরে তৃণমূলের তরফে এ দিন অবশ্য বিশেষ প্রতিক্রিয়া মেলেনি। খোদ অভিষেকের বক্তব্য জানা যায়নি। তিনি ফোন ধরেননি। মুখ খোলেননি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও। তাঁরা প্রতীক্ষায় আছেন দলনেত্রীর নির্দেশের। প্রশ্নের জবাবে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “কী অভিযোগ হয়েছে, খোঁজ নিই। প্রতিক্রিয়া যা দেওয়ার, কাল (সোমবার) দেব।” শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য বলেন, “গৌতম দেবের কথায় যত কম গুরুত্ব দেওয়া যায়, তত ভাল! ব্যাপারটা এখন ক্রমশই মূল জায়গা থেকে সরে এসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কার পরিবারের লোক কী ব্যবসা করেন, কে কার সঙ্গে দেখা করেন, এ সব নিয়ে চর্চা হচ্ছে!” প্রসঙ্গত, গৌতমবাবু এ দিন ফের অভিযোগ করেছেন, কালিম্পঙের ডেলো-য় এক রাতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হাজির ছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্তবাবু।
সিপিএম যখন ক্রমেই সুর চড়াচ্ছে, তৃণমূলের অন্দরের সমীকরণও নতুন মাত্রা পাচ্ছে! তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী এ দিনই যেমন আবেদন করেছেন, যাঁরা ভুঁইফোঁড় সংস্থায় টাকা রেখেছেন, ফেরত নিয়ে নিন! ওই সব সংস্থার এজেন্টের কাজ ছেড়ে ১০০ দিনের কাজ করুন! হুগলির পাণ্ডুয়ায় এক সভায় ওই ধরনের এজেন্টদের উদ্দেশে শুভেন্দু বলেন, “প্রতারণা করবেন না। টাকা ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে নুন-ভাত খেয়ে জীবনযাপন করুন!” জনগণের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, “চিট ফান্ডে টাকা রাখবেন না। পোস্ট অফিস বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা জমান।” আর ওই সংস্থাগুলির প্রতি তাঁর ঘোষণা, “সৎ সাহস থাকলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিয়ে নিজেদের প্রকৃত স্বল্প সঞ্চয় সংস্থা বলে প্রমাণ করুন। এর জন্য বিজ্ঞাপন দিতে হবে না!”
ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে শুভেন্দুর এ দিনের বক্তব্য যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ। তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, ওই মত শুভেন্দুর ব্যক্তিগত। টাকা খোয়ানোর বিপদ থেকে সাধারণ মানুষকে তিনি সতর্ক করেছেন জনপ্রতিনিধি হিসাবে। তবে তৃণমূলের অন্দরে শুভেন্দু যে হেতু এই ধরনের সংস্থার সঙ্গে জড়িত নেতাদের বিরুদ্ধে সরব, তাই তাঁর কথার ভিন্ন তাৎপর্য খোঁজা হচ্ছে দলেই!
শুভেন্দু অবশ্য সভাতেই বলেছেন, বাম আমলেই ভুঁইফোঁড় সংস্থার রমরমা হয়েছিল। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সারদা-কর্তাকে গ্রেফতার করে নজির সৃষ্টি করেছেন। সারদা-কর্তার চিঠির সূত্রেই নাম জড়িয়েছে তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের। তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না, জানতে চাওয়া হলে এ দিনই পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “তিনি (কুণাল) ওই সংস্থায় কাজ করতেন। তা নিয়েই টানাটানি হচ্ছে। অথচ বড় বড় সংবাদপত্রে ওই সংস্থার বিজ্ঞাপন দেখেই মানুষ বিশ্বাস করে সেখানে লগ্নি করেছে।” কিন্তু রাজ্য ওই সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কি? সরাসরি জবাব এড়িয়ে ফিরহাদের মন্তব্য, “মানুষই এর বিচার করবে।”
ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির দৌরাত্ম্য ঠেকাতে কাল, মঙ্গলবার নতুন বিল আসছে বিধানসভায়। এর ফলে গোটা প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হবে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ফিরহাদ পাল্টা বলেন, “সিপিএম বিষয়টাকে গুলিয়ে দিতে চাইছে। আসলে তদন্ত হলে যে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়বে!”
বুদ্ধবাবুও নতুন বিলের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, “আমাদের সময়ে আইন ছিল না। ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি দণ্ডবিধি নিয়েই নেমেছিলাম। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল, তুলে এনেছিলাম! কিন্তু বুঝেছিলাম, আইন না-করলে অনেক ফাঁক থেকে যাচ্ছে। তাই ২০০৩ সালে বিল এনেছিলাম।” ২০০৯ সালে পাশ হওয়া বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে দীর্ঘ দিন পড়ে থাকার পিছনেও নাম না-করে তৃণমূলের দিকে ইঙ্গিত করে বুদ্ধ বলেন, “বারবার বলছিলাম, বিলটা ছেড়ে দিন। এখান থেকে কেউ কেউ বলেছিলেন, না! একদম ছাড়বেন না! তা হলে সমস্যা হবে। এখন বুঝতে পারছি। পরে আরও বোঝা যাবে!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.