ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার কাণ্ডকারখানা নিয়ে যখন রাজ্য জুড়ে ঝড় উঠেছে, তখন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার মতো জায়গা এখনও তৈরি করে উঠতে পারেননি তাঁরা। সিপিএমের পলিটব্যুরোর এক সদস্য বলেন, “আমাদের এখন প্রয়োজন একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! যে মমতা বিরোধী দলের আন্দোলনকে এমন এক চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে যাবেন, যেখানে মহাকরণ সেই পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাবে।”
আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে নিজেদের ব্যর্থতার কথা পরোক্ষে মেনেই নিচ্ছেন সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁরা স্বীকার করছেন, প্রথমত, গত দু’বছরে মমতা-সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বিষয়ে অসন্তোষ তৈরি হলেও সেই রাজনৈতিক পরিসর এখনও দখল করতে পারেনি সিপিএম। দ্বিতীয়ত, ৩৪ বছর লাগাতার ক্ষমতায় থাকার ফলে সাধারণ মানুষের মনে সিপিএম সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছিল, তা এই দু’বছরের মধ্যে বিশেষ বদলায়নি।
সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু সিপিএম নেতারা স্বীকার করছেন, তাদের দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন মমতা যে কোনও বিষয় নিয়ে যে ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, যে ভাবে ‘স্ট্রিট-ফাইটার’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, সে ভাবে সিপিএমের কোনও নেতাকে দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, সেটিকে মূলধন করেই মমতা আমজনতার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে কখনও মহাকরণ অবরোধ করেছেন, কখনও ব্রিগেডে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন। এটা কিন্তু সিপিএম এখনও অবধি করে উঠতে পারেনি। বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতার সভায় যত জনসমাগম হত, সিপিএমের ডাকা সভায় সেই জনতা হয় না এখনও। |
ভুঁইফোঁড় লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিক্ষোভ। রবিবার কলকাতায়।—নিজস্ব চিত্র। |
সিপিএমের শীর্ষ নেতারা অনেকে আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হচ্ছে। দলের এক শীর্ষ নেতা বললেন, “বিধানসভা নির্বাচনের এখনও তিন বছর বাকি। এখনই সিপিএম কেন মরিয়া হয়ে সংঘাতের পথে যাবে? এখন তো ঠান্ডা মাথায় দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করতে হবে।” কিন্তু জেলায় জেলায় বহু সিপিএম নেতা মনে করছেন যে, আসলে রাজ্য নেতারা অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছেন। তাঁদের অনেকের বয়স হয়ে গিয়েছে, তাঁরা অনেকে সুখী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। ফলে নিজেদের ফাঁকিবাজি এবং আলস্যকে দীর্ঘমেয়াদি ব্লু-প্রিন্টের নামে আড়াল করতে চাইছেন। মমতা যখন আন্দোলন করতেন, তখন তিনি কিন্তু অত সাত-পাঁচ ভেবে আন্দোলন করতেন না। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ১৯৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারানোর পর থেকে মমতা দীর্ঘদিন শুধু বিরোধী হিসেবেই রাজনীতি করে গিয়েছেন। ক্লান্ত বা হতাশ হননি। সিপিএম-ই বা কেন আজ সেই স্বতঃস্ফূর্ততা হারাবে?
সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন, বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্র হিংসার রাজনীতিতে ফিরতে চাইছেন না। তিনি গঠনমূলক এবং ইতিবাচক বিরোধী দলের ছবি তুলে ধরতে চাইছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, বিমান বসু প্রমুখ নেতারা মনে করেছেন ষাট-সত্তরের দশকে বাম রাজনীতির যে মারমুখী ভাবমূর্তি ছিল, আজ তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। বুদ্ধদেব-নিরুপমের বক্তব্য, ইতিহাস পিছন দিকে হাঁটে না। সময় লাগতে পারে। কিন্তু সস্তায় বাজিমাত করার জন্য বাস পোড়ানোর রাজনীতি এখন অনুচিত। সিপিএম সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক কালে যোজনা কমিশনের সামনে আন্দোলন করতে গিয়েই সিপিএমের মুখ পুড়েছে। এখন চিট ফান্ড নিয়ে চটজলদি রাস্তার রাজনীতিতে নেমে যে সে রকম কিছু হবে না, তা কে বলতে পারে? বরং মানুষের অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে। এ অবস্থায় চটজলদি প্রতিক্রিয়ার পথে না গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পথে হাঁটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সিপিএমের অন্দরে এখন এটাই সবচেয়ে বড় বিতর্ক। কারণ সিপিএমের জেলা নেতারা মনে করছেন, চিট ফান্ড-কাণ্ডে প্রধান আক্রান্তরা হলেন গ্রামীণ গরিব মানুষ। জেলায় জেলায় এই আমানতকারীরাই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান ভোটব্যাঙ্ক। সারদা-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। বহু জেলায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। এমন একটা অবস্থায় সংবাদ চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়া ছাড়া সিপিএমের আন্দোলনটা কোথায়? এই পরিস্থিতিতেও দল যদি রাস্তায় না নামে, তা হলে আর কবে নামবে? তবে কি দলের মধ্যে এই ভুঁইফোঁড় সংস্থার থেকে সুবিধা পাচ্ছেন এমন কিছু নেতা আছেন এবং সেই কারণেই কি দলের ঝাঁপিয়ে পড়তে অসুবিধা? নাকি লড়াকু নবীন প্রজন্মের কোনও প্রতিনিধির ছবি সামনে না থাকায় সে ভাবে ঝাঁপাতে পারছে না দল? সিপিএমের নেতারাই প্রশ্ন তুলছেন, চিট ফান্ড-কাণ্ডে এই প্রথম মমতা-সরকারে বিরুদ্ধে যখন একটা গণঅসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তখন দলের আন্দোলন কোথায়? মমতা ‘সিপিএমের সন্ত্রাসের’ প্রতিবাদে দিল্লির বোট ক্লাবে অবস্থান করেছেন। ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করেছেন যন্তরমন্তরে। সেখানে ‘তৃণমূলী সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিলেও দেশ জুড়ে সিপিএম সে ভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না কী কী কারণে, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরেই।
তাই সিপিএম নেতারা বলছেন, ‘আমাদের দলের প্রয়োজন একজন মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়!’ |