শুধু আর্তনাদ বা বিক্ষোভ নয়। সুরাহার আশায় প্রতারিত মানুষজন যে তদন্ত কমিশনের দিকেও তাকিয়ে আছেন, তার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গড়া হয়েছে শুনেই সেখানে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন অন্তত ৩২ জন। এবং আজ, মঙ্গলবারেই শুনানি শুরু করছে কমিশন। সোমবার কমিশনের প্রথম বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রথা অনুযায়ী সরকারি ভাবে বিজ্ঞপ্তি বেরোনোর পরেই অভিযোগ নেওয়ার কাজ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এ দিনের বৈঠকের পরে কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শ্যামলকুমার সেন বলেন, “ইতিমধ্যেই ৩২ জন মানুষ দফতরে এসে অভিযোগপত্র পেশ করে গিয়েছেন। তাঁদের উদ্বেগের কথা ভেবেই মঙ্গলবার শুনানি শুরু হচ্ছে।” উচ্চ পর্যায়ের ওই তদন্ত কমিশনে রাখা হয়েছে রাজ্য অর্থ নিগমের চেয়ারম্যান অম্লান বসু এবং পুলিশকর্তা যোগেশ চট্টোপাধ্যায়কে। কমিশনের অন্য দুই সদস্যের নাম এখনও ঘোষণা করা হয়নি। এ দিন কমিশনের প্রথম বৈঠকে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাস্ট্রসচিব, অর্থসচিব এবং ডিজি।
শ্যামলবাবু জানান, সরকারি বিজ্ঞপ্তি বেরোনোর পরে কলকাতায় কমিশনের অফিস ছাড়াও দুর্গাপুর, রাজারহাট (নিউ টাউন) ও শিলিগুড়ির মাটিগাড়ায় অভিযোগ জমা নেওয়া হবে। মহাকরণ সূত্রের খবর, জেলার বাসিন্দাদের কথা ভেবেই রাজ্যের একাধিক জায়গায় অভিযোগপত্র পেশের কেন্দ্র খোলার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
শামিয়ানার তলায় আমানতকারী-এজেন্টদের জমায়েত। রাজারহাট-নিউ টাউনে। |
কোন এলাকার বাসিন্দা কোথায় অভিযোগপত্র জমা দেবেন?
শ্যামলবাবু বলেন, “দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলার মানুষ রাজারহাটে ফিনান্সিয়াল হাবে, কয়েকটি জেলার মানুষ দুর্গাপুরে এবং উত্তরবঙ্গের মানুষ মাটিগাড়ায় অভিযোগপত্র পেশ করতে পারবেন। ওই সব জায়গায় সরকারি কর্মীরাই আমানতকারী ও এজেন্টদের কাছ থেকে অভিযোগপত্র নেবেন। তাঁরা তা পাঠিয়ে দেবেন কমিশনে। কমিশনের অফিসেও অভিযোগজমা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ডাকেও অভিযোগ পাঠানো যাবে। অভিযোগ গ্রহণ করা হবে অনলাইনেও।
জেলায় জেলায় অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র কবে চালু হবে? শ্যামলবাবু বলেন, “সবিস্তার সূচি সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। আগামী দু’তিন দিনের মধ্যেই ওই বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।” |
সাংবাদিকদের মুখোমুখি শ্যামল সেন। |
কমিশন কী কী দেখবে?
শ্যামলবাবু জানিয়েছেন, সারদা গোষ্ঠীর মোট সম্পত্তি কত, দায় কত এবং কত জন আমানতকারী টাকা পাবেন, কমিশন তা খতিয়ে দেখবে।
৫ নম্বর কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে তদন্ত কমিশনের অফিসে এ দিন সারদা গোষ্ঠীর জনা তিরিশ এজেন্ট ও আমানতকারীরা জড়ো হন। তাঁদের অনেকেই ওই গোষ্ঠীর বারুইপুর শাখার এজেন্ট বা গ্রাহক। কোন প্রকল্পে কত দিন ধরে কত টাকা জমা দিয়েছেন, কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগে সবই জানান তাঁরা। সেই সঙ্গে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করার আর্জিও জানান কমিশনের কাছে।
আমানতকারীদের অভিযোগ, টাকা ফেরত চেয়ে কী ভাবে আবেদন করতে হবে, অভিযোগ জানানোর ধরন কী হবে, সেই বিষয়ে এ দিনও কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। কমিশনের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, সরকারি বিজ্ঞপ্তি বেরোলেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।
রাজারহাট-নিউ টাউনেও এ দিন হাজির হয়েছিলেন শ’খানেক আমানতকারী। আমানতকারী ও এজেন্টদের জন্য সেখানে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। খোলা হয়েছে পুলিশের একটি হেল্প ডেস্কও। অস্থায়ী শৌচাগারও তৈরি। শামিয়ানার তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কণিষ্ক চৌধুরী নামে বেহালার এক বাসিন্দা এবং তাঁর বোন কৃষ্ণা চক্রবর্তী। কণিষ্কবাবু বলেন, “বিধাননগর কমিশনারেট থেকে জানানো হয়েছিল, সকাল ১০টা থেকে হিডকোর ফিনান্স অফিসে সার্টিফিকেট জমা নেবে। খুব ভিড় হবে ভেবে সকাল ৮টায় চলে এসেছিলাম। বেলা ৩টে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কিছু হল না। অফিস ছুটি নিয়ে হয়রানির চূড়ান্ত হল।” কণিষ্কবাবু ও তাঁর বোন দু’জনে মিলে কয়েক লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন সারদায়। মার্চ পর্যন্ত সুদ পেয়েছেন। তার পরে আর কিছুই পাননি। কৃষ্ণাদেবী বলেন, “আমাদের সুদ দরকার নেই। আসলটা ফেরত পেলেই যথেষ্ট। প্রথম দিনেই যা অব্যবস্থা দেখলাম, মনে হচ্ছে, টাকা ফেরত পাওয়াটা বিশ বাঁও জলে!”
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, পরিকাঠামোগত কিছু ত্রুটির জন্য এ দিন কাজ হয়নি। তবে মঙ্গল-বুধবারের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। |