১৪টি ভেন্টিলেটরের জন্য ১৪ মাসেরও বেশি অপেক্ষা করছেন এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ভেন্টিলেটর তো আসেইনি। এমনকী, সেই সংক্রান্ত ফাইলটিও স্বাস্থ্য ভবনে বিশেষ নড়াচড়া করেনি বলে অভিযোগ। অথচ, ওই ১৪টি ভেন্টিলেটর গত দেড় বছরে কয়েকশো রোগীর প্রাণ বাঁচাতে পারত।
এ তো গেল রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের পরিস্থিতি। বাকিদের কী অবস্থা? নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কার্ডিয়াক মনিটরের অভাবে পরিষেবা ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। কলকাতা মেডিক্যালে হল্টার মেশিন কেনা আটকে। ন্যাশনালে ভেন্টিলেটরের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছেন। বধর্র্মান মেডিক্যালে অস্ত্রোপচারের টেবিল প্রয়োজন, কিন্তু কেনা যাচ্ছে না। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে স্ত্রী-রোগ বিভাগের কিছু জরুরি সরঞ্জামের ঘাটতিতে পরিষেবার সঙ্গে আপস চলছে প্রতিনিয়ত। টাকার অভাব নেই। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সমস্যার উৎস একটাই। লাল ফিতের ফাঁস।
সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে কেনাকাটার অনুমতি আদায় করতে যে ফাইল স্বাস্থ্য ভবনে ঢুকছে, তা আর সহজে বেরোচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাজে গতি আনার যে নির্দেশ গোড়াতেই দিয়েছিলেন, তা তাঁর নিজের দফতরেই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন সরকারি চিকিৎসকদেরই একটা বড় অংশ।
অথচ এই ধরনের সমস্যার সমাধানেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ফাইল চালাচালিতে আসল কাজটা যাতে পিছিয়ে না যায়, সে জন্যই মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের হাতে ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল। স্থির হয়েছিল, ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত তাঁরা খরচ করতে পারবেন। কিন্তু কোনও খরচ ১০ লক্ষের অঙ্ক ছাড়ালে অর্থ দফতরের সিলমোহর লাগবে। মহাকরণে অর্থ দফতর ঘুরে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। সেই কারণেই প্রক্রিয়ার সরলীকরণের জন্য স্বাস্থ্য ভবনে তৈরি হয়েছিল ‘ফিনান্স অ্যাডভাইসার’ পদ। উদ্দেশ্য, কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় গতি আনা। টাকার অনুমোদনের অভাবে কোনও প্রকল্প যাতে আটকে না যায়, তা নিশ্চিত করা।
বাস্তবে কী হচ্ছে? সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ-কর্তাদেরই অভিযোগ, জরুরি সরঞ্জাম কেনা আটকে রয়েছে। জঞ্জাল সাফাই, রোগীর পথ্য সংক্রান্ত ফাইলও পাশ হয়নি বহু জায়গায়। যে ১৪টি ভেন্টিলেটর কেনা এসএসকেএমে আটকে, তার মধ্যে চারটি ভেন্টিলেটর শিশুদের ওয়ার্ডের জন্য। চিকিৎসকরা স্বীকার করছেন, পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটরের অভাবে বহু শিশুকে তাঁরা বাঁচাতে পারছেন না।
এসএসকেএমের এক কর্তার কথায়, “হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য ভবনে ছুটে ছুটে আক্ষরিক অর্থেই জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফাইল নড়ছে না। এ ভাবে চললে পরিষেবা ধাক্কা খাবেই।”
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের এক কর্তা বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখুন, এক বছরে ক’টা ফাইল বেরিয়েছে? আমাদের বেশ কিছু সরঞ্জামের পারচেজ অর্ডার বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফাইল আসেনি। একে তো টেন্ডারের প্রক্রিয়াগত জটিলতা। তিনটির বেশি টেন্ডার না হলে প্রক্রিয়া শুরু হবে না। তার উপরে এই শামুকের গতি। সব মিলিয়ে প্রাণাম্ত অবস্থা।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় গতি কী ভাবে আনা যায়, সে নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। স্থির হয়েছে বেশ কিছু প্রক্রিয়াও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবই বিফলে গিয়েছে। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “ভেন্টিলেটরের অভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর খবর পাচ্ছি আকছার। আমাদের টাকা নেই, তা তো নয়। সমস্যা হল, টাকা থেকেও সময় মতো তা খরচের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এটাই দুর্ভাগ্যের। অন্য ফাইল আটকে রাখা আর স্বাস্থ্যের ফাইল আটকে রাখা যে এক নয়, তা বোঝা দরকার।”
কেন ফাইল নড়তে এত সমস্যা? ফিনান্স অ্যাডভাইসার রূপেন চৌধুরী জানিয়েছেন, দফতরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করবেন না, যা বলার স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস বলবেন। অসিতবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “অভিযোগের সঙ্গে সহমত নই। প্রক্রিয়া মেনে কাজ হচ্ছে। ফাইল ঠিকঠাক না দেখে ছাড়লে আর্থিক নয়ছয়ের ভয় থাকে।” |